Skip to main content

সুদীপ্ত ভাস্কর দত্তের ছোটগল্প। ২০২১ : করোনার পরে।

audio testing
গল্পকারের কণ্ঠে গল্প পাঠ 
২০২১ : করোনার পরে

নদীর জলটা এত টলটলে, পরিষ্কার আগে দেখিনি কোনদিন! পাড়ে বসে একটা মুগ্ধতা নিয়ে স্বগতোক্তি করল অরুণ। বসন্তের আরম্ভে এই মৃদুমন্দ বাতাসটা প্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছিল।। পড়ন্ত বিকেলে নির্জন নদীর তীরে, গাছের পাতার আড়াল থেকে একটা বউ কথা কও মাঝে মাঝে ডেকে উঠছিল। করোনা মহামারী রোধের চেষ্টায় সারা পৃথিবী জুড়ে যে লক ডাউন চলেছিল, তার ফলেই প্রকৃতি এখন দূষণমুক্ত, নির্মল।
কিন্তু এত মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশেও বছর ৩০এর অরুণের মনে আনন্দ নেই। করোনা প্রকোপ কমে যাওয়ায় এবং লক ডাউন উঠে যাওয়ার পর এই প্রথম বান্ধবী, শ্রেয়সীর সাথে তাদেরই প্রিয় মিলন স্থলে দেখা করতে আসা, প্রায় এক বছর পর। আসলে, বাধ সাধল শ্রেয়সীর মেজাজ। এসে থেকেই মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে প্রায় ১ ঘন্টার ওপর। তাও আবার ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে! লক ডাউনের আগেই দুজনের ঝগড়া হয়েছিল। রেগে গিয়ে শ্রেয়সী সবরকম যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। পুরো লক ডাউনটাই খুবই মনোকষ্টে কাটে অরুণের। সম্ভবতঃ শ্রেয়সীরও। করোনা পরিস্থিতি দূর হওয়ার পর অনেক চেষ্টাচারিত্র করে তাকে আজ এখানে আসতে রাজি করিয়েছে অরুণ।

সুন্দরী বান্ধবীর দিকে একটা পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে অরুণ বলে ওঠে, এত দূরে দূরে বসে কি করে কথা বলব?
ঝাঁঝালো উত্তর আসে, যা বলার দূরে বসেই বল।"
বলছিলাম কি, সোস্যাল ডিস্ট্যান্সিংস, সরি, ফিজিক্যাল ডিস্ট্যান্সিং এখন আর মেন্টেইন করার দরকার নেই। আমি কিছুদিন আগে ভ্যাকসিন নিয়ে নিয়েছি।
ভ্যাকসিন বাজারে আসতে না আসতেই নেওয়া হয়ে গেল!
ব্যবসা করে খাই। আমাকে তো বাড়ি বসে থাকলে চলবেনা। অগত্যা নিতেই হল।
ভালো। তোর টাকা আছে নিয়েছিস! কোটি কোটি গরিব ভারতবাসীর কী হবে! ওরা কী করে এই ভ্যাকসিন কিনবে!
কি মুশকিল! সারা ভারতবর্ষের দায়িত্ব বুঝি আমার! আমার ছোট ব্যবসা। লক ডাউনের সময় কি মারটাই না খেলাম! তবুও গতমাসের রোজগারের পুরোটাই এক এনজিও কে দিয়ে দিয়েছি। ওরা এখন লক ডাউনে রোজগার হারানো মানুষদের জন্য কাজ করছে।
শেষের কথাটা বলে আড় চোখে একবার শ্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে নেয় অরুণ, ভাবে এতে হয়তো চিঁড়ে ভিজবে। কথাবার্তার মধ্যেই অরুণ ওদের মাঝের ব্যবধান ১ ফুট কমিয়ে ফেলেছিল। যদিও শ্রেয়সীর চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি। সে অরুণকে রাগী চোখে ইশারা করে দূরে সরে বসার জন্য। সরতে সরতেই অরুণ ইতস্তত করে বলে, তুইও ভ্যাকসিনটা নিয়ে নে। আবারও ঝাঁঝালো জবাব আসে, আমার একার নিলে হবে! বুড়ো বাবা মা, আমার ভাই, বোন, ওদের কি হবে? অরুণ চুপ করে যায়। সত্যিই ওর ঘাড়ে অনেক দায়িত্ব। কিছুক্ষণ নীরবতা। বউ কথা কও পাখিটা আবার ডেকে ওঠে। শ্রেয়সী মুখ খোলে, আশাকরি, তোর কথা আর দেখা শেষ। এবার বাড়ি যা। আমিও উঠবো। অরুণের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। প্রায় চেঁচিয়েই বলে ওঠে, মেয়েদের এই ফালতু, অযৌক্তিক রাগ! অসহ্য!
আগুনে যেন ঘি পড়লো। ক্ষিপ্ত শ্রেয়সী গলা তুলে বলে, কী বললি? ফালতু রাগ! আর, আবারও মেয়েদের হেয় করলি! আচ্ছা, বলতো জার্মানি, তাই ওয়ান, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড এই সব দেশগুলোতে করোনার প্রকোপ কম হয়েছিল কেন, আর মৃত্যুর হারও কম ছিল কেন?
এই আপাত অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন শুনে অরুণ কি জবাব দেবে ভেবে পায়না। শ্রেয়সী বলে চলে, জানিসনা তো? তবে শোন, ওই দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানরা সবাই মহিলা। আর ওঁরা অন্যান্য সব উন্নত দেশগুলোর পুরুষ রাষ্ট্রপ্রধানদের থেকে করোনা মহামারীকে অনেক ভালোভাবে সামলেছেন।

এই অসাধারণ, অজানা তথ্য শুনে অরুণ একই সাথে বিস্মিত ও মুগ্ধ। প্রিয়তমা বান্ধবীর রাগে লাল হয়ে যাওয়া আকর্ষণীয় মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অরুণের মনে পড়ে গেল ওর বন্ধু, দেবায়নের সেই আপ্তবাক্য, মনে রাখিস, একই সাথে রূপসী আর বিদুষী হওয়াটা কিন্তু deadly combination! Handle করাটা খুব চাপের।" কিন্তু এই কম্বিনেশনটাই তো অরুণকে টানে!

এদিকে শ্রেয়সী ইতিমধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে। অগত্যা, অরুণকেও উঠে পড়তে হল। শ্রেয়সী নিজেকে সামলে নিয়ে একটু শান্ত গলায় বলে, যা, তুই স্টার্ট কর। অনেকটা রাস্তা তোকে বাইক চালাতে হবে। সন্ধ্যা নামবে এক্ষুনি। ওর কণ্ঠস্বরে সেই পুরনো স্নেহের পরশটা ফিরে এসেছে দেখে, অরুণ ভরসা পেয়ে বলল, চল, তোকে নামিয়ে দিচ্ছি । সঙ্গে সঙ্গেই কড়া জবাব আসে, না, দরকার নেই।
কেন, কী প্রবলেম? আমি তোকে তোর বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যাব।
না মানে না। তোকে উল্টোদিকে যেতে হবে না। আমি টোটো ধরে নেব। তুই রওনা হয়ে যা। রাস্তাটা ভালো না। অন্ধকার নেমে যাবে।
জিদ্দি মেয়ে এক পিস! মনে মনে বলে অরুণ। তারপর ধীর পায়ে ওর স্ট্যান্ড করা বাইকের দিকে এগিয়ে যায়। হেলমেট পরতে যাবে, শুনতে পেল ওর গলা, বাহ! কি সুন্দর পাখিটা! অরুণ ঘুরে দেখে শ্রেয়সী পাশের শিরীষ গাছটার একটা ডালের দিকে তাকিয়ে আছে। দ্রুত ওর কাছে চলে আসে অরুণ আর পাখিটার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, আরে এটাতো একটা কলার্ড কিংফিসার! এখানে কতবার এসেছি কিন্তু এরকম পাখি তো আগে দেখিনি! লক ডাউনের মিরাকেল!" তখনই শ্রেয়সীর পারফিউমের মিষ্টি গন্ধটা ওর নাকে আসে। ওকে জড়িয়ে ধরার এক অপ্রতিরোধ্য ইচ্ছে অনুভব করে অরুণ। কিন্তু মহারানি তৎক্ষণাৎ সরে গেছেন।

বাইকের চাবি ঘুড়িয়ে ইঞ্জিন স্টার্ট করে রওনা হতে যাবে, অরুণ শুনতে পেল, শোন, একটু দাঁড়া। শ্রেয়সী এগিয়ে এসে বিনা বাক্যব্যয়ে ওর পিছনে উঠে বসে। অরুণ খেয়াল করে, স্পর্শ এড়িয়ে মাঝখানে গ্যাপ রেখে বসেছে তার 'রূপসী ও বিদুষী' বান্ধবী। ও মনে মনে বলে, নখরেওয়ালী ভাঙবে তবু মচকাবে না! বাইক চালিয়ে দেয় অরুণ। নদীর ধার থেকে বড় রাস্তায় উঠে পশ্চিম দিকে মোড় নিতেই অরুণ অনুভব করে তার ডানকাঁধে সেই পরিচিত কোমল হাতের স্পর্শ। আর তখনই পশ্চিমের আকাশটা এক অদ্ভুত লালচে গোলাপি রঙে রাঙিয়ে ওঠে। অরুণ ভাবে, এটাও কি করোনা জনিত লক ডাউনের পজিটিভ আফটার এফেক্ট, নাকি... ।

ও বাইকের গতি কমিয়ে দেয়। 

Comments

Popular posts from this blog

আলী হোসেনের ছোটগল্প। এক এক্কে এক।

এক এক্কে এক : ছোট্ট বেলা নামতা পড়ার সময় এভাবেই শুরু করত মান্তু। তখন জানতো না কি এর মানে, কেনই বা পড়তে হয়। মা বলতেন, নামতা হল অঙ্কের মাথা। কিম্বা মেরুদণ্ডও বলতে পারিস। এটা ঠিকঠাক না শিখলে অঙ্ক মেলে না। যখন প্রাথমিক স্কুল ছেড়ে মাধ্যমিকে পৌছেছে, তখন মায়ের কথার মানে বুঝেছে মান্তু। কিন্তু পরিণত বয়সে এসে, আজ বুঝেছে এর অন্য মানে। এটা না জানলে, জীবনের মানেটাই পালটে যায়। মিলতে চায় না জীবনের অঙ্কটাও। মান্তু তখন ক্লাস এইটে। হঠাৎই দুঃসংবাদটা এলো। ক্লাসে সেলাই দিদিমনি, ফ্রেঞ্চনটের গীট ধরে আটকানোর চেষ্টা করছেন। বোঝাচ্ছেন, কিভাবে একে কব্জা করতে হয়। মান্তু কিছুতেই এই গিঁটকে কব্জা করতে পারছেনা। মাথার ওপর বোঁবোঁ করে ঘুরছে পাখা, অথচ ঘামের স্রোতে ভাঁটার টান নেই মোটেও। বাইরের বাতাসে উত্তাপের পারদ নিশ্চয়ই লু-লেবেল ছাড়িয়েছে। বাতাসের শুষ্ক বুকে তরঙ্গ তুলে সে ছুটে চলেছে শরীর জুড়াতে আন্য কোথাও, অন্য কোনখানে। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে চাঁদনি থেকে দোকানের মাল নিয়ে ফিরছিল ফারহাদ। হঠাৎই চরকির মত ঘুরে গেল মাথাটা। পিচ-গলা রাস্তায় আছড়ে পড়লো মস্ত শরীর। পথ-চলতি নজর চকিতে ঘুরে এল ফারহাদের দিকে। কে বলে কলকাতার হৃদয়ে উষ্ণতার অভা...

মুর্শিদ এ এম - এর গল্প। ঠুনকো।

পুরো গল্প পড়তে গল্পকারের নাম -এর ওপর ক্লিক করুন ।। হোম পেজ-এ যেত এখানে ক্লিক করুন audio testing গল্পকারের কণ্ঠে গল্প পাঠ।  ঠুনকো একের পর এক প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে একেবারে দক্ষিণে, মনে হচ্ছিল একটু গেলেই সাগর এগিয়ে আসবে, একলা ত্যাজ্যপুত্রের মতো দাঁড়িয়ে থাকা এক্সপ্রেস ট্রেনটা দেখতে পেল ইয়াসিন। সাউথ ইন্ডিয়া যাবার প্রায় সব ট্রেন এই দিকের প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়ে। বন্যার কারণে কয়েকটি ট্রেন বাতিল হওয়ার পর কদিন হল খুলেছে। একাই এতটা পথ লটবহর টেনে গলদ্ঘর্ম হয়ে কামরায় ঢুকে নিঃশ্বাস ফেলল সে। এখনও এ সি চলেনি। চললে অসুবিধেই হত, হঠাৎ লেগে যেত ঠান্ডা। নিজের সিট খুঁজে মালপত্র রেখে চোখ-মুখ ধুয়ে, টুপিটা খুলে আবার পরে নিয়ে, ঘন সুবিন্যস্ত দাড়ি ভেজা হাতে মুছে খানিকটা জল খেয়ে স্বস্তি পেল যেন। একটা কালো ঢাউস ব্যাগকে কিছুতেই কব্জা করতে না-পেরে পায়ের কাছেই রেখে দিল ইয়াসিন।

নয়ারুণ ভট্টাচার্য্য

রেবন্তর স্ববধবিলাস ‘No one ever lacks a good reason for suicide’         - Cesare Pavese (1908-50) কাল এক দীর্ঘ, দীর্ঘ রাত্রিব্যাপী পরিক্রমায় গৃহত্যাগ করিব। পরিক্রমার অন্তে দেখিব তরঙ্গবিক্ষুব্ধ এক অপার জলধি। মৃত্যু কী এমনই দেখিতে? ভাবিলেও রোমাঞ্চকণ্টকিত