ফুরিয়ে না-যাওয়া মানুষটা
এরপর আমাদের পরম প্রতিভাবান চাচার কথা বলি। বলতে হয় চাচা, কিন্তু বয়েস আমাদের
চেয়ে কিঞ্চিৎ ভারী। আমি একসময় এই চাচাকে সিগারেট অফার করেছিলাম; সে অনেক দিনের কথা,
যখন আমরা নিজেদের ভাগ্য ফেরানোর জন্যে ইন্সিওরেন্স কোম্পানির মতো দেখতে এক
কোম্পানিতে জয়েন করেছিলাম। চাচা সিগারেট সেদিন নেয়নি, নিত না, আজও কোনো নেশা নেই।
আল্লা না করুন, নেশা কেন করতে যাবে চাচা! আমাদের সামনে ইনসান বা কাদের বা খয়রুল
নেশা করে করে নিজেদের কোন সর্বনাশের সামনে দাঁড় করিয়েছে, তা কি আমরা দেখিনি। এদের
মধ্যে ইনসানকে, বেশ কিছুদিন অবধি প্রতিরাতে ধুলোমাখা রাস্তায় গড়াগড়ি খেতে দেখে
তাকে তার ভাগ্যের উপর হায়াতটুকু ছেড়ে দিয়ে, অথবা আল্লা তার যেটুকু জিন্দেগি
রেখেছেন তার উপর অটুট বিশ্বাসে, পাশ কাটিয়ে লোকজন সরে যাবার পর -- মরতে হয়েছে
সরকারি হাসপাতালের মেঝেয়। বাকি দুজন ভাগ্যি জামাতের লোকদের নেকনজরে পড়েছিল বলে
বেঁচেবর্তে আছে। তারা এখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি, আর ফি রোববার জামাত বাঁধা। কথিত আছে
ওদের মধ্যে যে গোস্ত বিক্রি করে সে নাকি একটু আধটু খায় এখনও। তবে সদাসর্বদা মাথা
থেকে টুপি যার নামে না, সে কি টুপি পরেই খায়। নাউজবিল্লাহ। ওটা হল অপপ্রচার।
ইসলামকে যারা এগোতে দিতে চায় না, তাদের গভীর এক ষড়যন্ত্র। আমরা বিশ্বাস করি খয়রুল,
যে এককিলো মাংসের সঙ্গে তিনশো গ্রামের জায়গায় আড়াইশো গ্রাম হাড্ডি দেয় খদ্দেরকে
খুশি করার মানসে সে এমন হতে পারে না।
কিন্তু এ কাহিনি তাদের বন্ধু সওগাতকে নিয়ে। আগেই বলেছি, সে আমার চাচা। সে এসব
থেকে শত হস্ত দূরে। তবে আমি তার সামনেই আজও সিগারেট খেয়ে থাকি। আর এ-গল্প সিগারেট
খাওয়া নিয়েও না।
কী কারণে জানি না চাচা; না, সওগাত প্রতিদিন আবুজমজমের পানি দিয়ে দুচোখ ধৌত
করে। আবু জমজমের পানির সঙ্গে তুরস্ক দেশের মহামান্য এক সুলতানের গোপন অভিসারের
কাহিনি সে-দেশের ইতিহাস কিংবা সাহিত্যে লিপিবদ্ধ থাকতে পারে -- তাতে কোনো আগ্রহ
আছে বলে শোনা যায়নি সওগাতের, তাহলে সে-পানিতে চোখের দৃষ্টিতে কি সজীবতা আনবার
চেষ্টায় ওই অভ্যাস চালু রাখেছে সে! হতে পারে। কেননা আমাদের মতো বা ওই গোস্ত ব্যবসায়ীটি
যে তার একসময়ের বন্ধু ছিল, তার মতো কোনো চশমা আজও সওগাতের চোখদুটোকে কন্টকিত করতে
পারেনি। তবে সন্ধ্যাকালীন বাজারে, যেটা তার একমাত্র জীবিকা এবং একমাত্র জৈবনিক
লক্ষ্যও বলা যায়, সেই মাল-মালাদি, শাক-শাকাদি বা সবজি-সবজিদি বিক্রির সময়, ইদানিং
যে দুটাকার কয়েন প্রবর্তন করেছেন ভারত সরকারের টাঁকশাল, সেটি চিনতে গেলে জেরবার
হয়। সাধারণ মানুষের জীবনে ইদানিং এত সুখ ও সমৃদ্ধি, শান্তি ও নিরাপত্তা প্রচণ্ড
ভাবে বেড়ে গিয়েছে যে ওই সামান্য দুটাকার কয়েন, যেটি একটাকার সঙ্গে মাপে, ওজনে,
হাবেভাবে, চরিত্রে, রঙে, রেখায়, ডিজাইনে, চেহারায়, জৌলুসে, এমনকী পি.সি.ও বক্সে
কয়েন ফেলার ফুটোর সঙ্গে মাপসই, তা মিলে গেলে ক্ষতিবৃদ্ধির সম্ভাবনা শূন্য শাতাংশ বললেই
চলে।
সওগাত যখন দিন শুরু করে তখন আমাদের ঘুমের মধ্যরাত। তখন আজান শুনতে হয় তাকে,
তারপর ওজু সেরে, কখনও কখনও গোসল সেরে; কেননা সত্তরের কাছাকাছি বয়েসে তার পিতা
সন্তান উৎপাদনক্ষম ছিলেন, অতএব তাকে অবমাননা করে সওগাতের স্ত্রীর দিক থেকে মুখ
ফিরিয়ে নেওয়াটা অন্যায় বলে, অথবা অন্য অনেক কারণে, জামার একটি হাতা গলিয়ে নেমে
পড়তে হয় পথে। প্রায় দৌড়ে গিয়ে জামাত ধরতে হয়। এবং একবার কাতারে দাঁড়িয়ে পড়লে চোখে
যতই ঘুম জড়িয়ে আসুক নামাজ আদায়ে কোনো সমস্যাই দেখা দেয় না। সওগাত তখন তারই মধ্যে,
লোক যতই বলুক মসজিদে ইহজগতের কথা ভাবা নিষেধ, সবজির পাইকারি বাজারে নিজেকে সেঁদিয়ে
দিয়ে, কোন মাল কিনলে বেশি পড়তা হবে, কোনটা কার কাছ থেকে গস্ত করতে পারলে দুটো পয়সা
চোখে দেখা যাবে -- তা ভাবে।
এইভাবে সওগাত, যার দুই ছেলে দুই মেয়ে, যাদের কাউকে বিয়ে দেয়া হয়নি, বা দিয়ে উঠতে পারেনি বা তারা বিবাহ
বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায়নি, অথচ আমাদের নাতি নাতনি পরিবেষ্টিত সংসারী মানুষদের থেকে
যার বয়েস সামান্য ভারী, কারণ তার বিয়েটাও হয়েছিল দেরিতে, আর বউ-এর ছিল কম বয়েস-- নামাজ
সেরে, মসজিদের গায়ে যেখানে নোটিশ লটকানো থাকে -- “এখানে নামাজি ছাড়া কোনো বাহিরের সাইকেল/বাইক রাখা
নিষিদ্ধ” হেলান দেয়া সাইকেলটি,
যেটিতে হ্যান্ড পাম্পে হাওয়া দেওয়ার রেওয়াজ এখনও ছাড়েন নি, তাতে হাতের তালুতে লাগা ধুলো মুছে পাড়ি দেয়
পাইকারি বাজারে।
সওগাতের জন্যে কোনো ব্রেকফাস্ট, ডিম টোস্ট, রুটি আলুরদম অথবা মালাই দুধের চা
বরাদ্দ রাখে না তার বউ। যেটুকু আয়োজন হয়, উনুনের আশপাশে ঘুরঘুর করতে থাকা আদ্দামড়া
বড়ো ছেলে, যাকে শত চেষ্টাতেও ক্লাস নাইনের বেশি ধাক্কানো যায়নি, চিররুগ্ন
ছোটোছেলে, যে শারীরিক কারণেই বাংলায় বিদ্যাভ্যাস করতে পারেনি অথচ আরবিতে একবার
কোরান খতমে পারদর্শিতা দেখিয়েছে, বড়োমেয়ে, যার বিয়ের বয়েস সমাসন্ন, অথচ ইস্কুলে
যায় এবং বেশ বোঝা যায়, তার ওই বিদ্যালয় গমনের পেছনে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকানো
চ্যাংড়াদের জটলাই মূল দায়ী, এবং কনিষ্ঠ কন্যা, যে তাদের সংসারে এমন ঔদাসীন্য আর
দারিদ্র আর অসহনীয় স্নেহবঞ্চনা থেকে নিষ্কৃতি পেতে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে চায়, অথচ
সর্বক্ষণ খিদে যার সঙ্গী, ফলে ওই রান্নাঘরের আশপাশ থেকে সরে যেতে যার মন চায় না,
এই কজন মিলে সাবাড় করে দিতে সময় নেয় না। এরপর যখন অবশিষ্টাংশ থেকে বউয়ের অর্থাৎ রৌশন
বিবির ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণ হয় না, তখন তার কণ্ঠ থেকে অশ্রাব্য মধুবাক্য নিঃসৃত
হতে শুরু করে।
আমাদের ঐতিহ্যশালী পাঁচিলঘেরা বৃহদাকার উঠানের মাঝে তা অকাতরে বর্ষিত হতে হতে
একসময় ধৈর্যচ্যুতি ঘটলে, একদা একান্নবর্তী পরিবারের এক কর্ত্রী, যিনি সওগাতের বউ
রৌশন বিবির পিসি হন এবং খুড়তুতো শাশুড়িও তিনি খেঁকিয়ে ওঠেন, ‘রোজ রোজ কিসির অত দরবার
রা, খাওয়া খাওয়া নে। তোরগা বাপের রোজগারপাতি নি, না তোরগা পয়সা কিছু কম দেছে আল্লা
তালা?’
“আমরা দরবার করতিচি, তা
তোমাদের এত ফাটতিচে কেন? একমুঠো দে তো সাহায্য করার মানুষ নি দুনিয়ায়। একলার
রোজগারে কি সোমসার চলে? কী করে চলে তা আল্লা পাক সেই জন জানে।” প্রত্যুত্তরে জানায়
রৌশন বিবি।
আল্লাপাক জানতে পারলে, কিংবা তার সমাধান কল্পে ব্যবস্থা নিলে তা পছন্দ অপছন্দর
ভেতর কোন তালিকায় পড়বে এই দোটানায় থাকার ফলে কর্ত্রীটি দ্বিতীয়বার বলেন, “দিনরাত তাসের আড্ডায়
পোঁদ রগড়ায় কেন তোরগা দামড়াটা? সে একটা কাজ কাম জুটকে নিতি পারে না!”
পারে যে না, এটা বিলক্ষণ জানা উচিত ছিল আমাদের। কিছু কিছু খবর আমাদের কানে আসে
বটে। আমরা যারা শুনতে পাই আমাদের ছেলে-পিলেদের চাকরি হবার নয় -- তাদের ঠাকুরদার
আমলে একচেঞ্জে নাম লেখানোর হিড়িক ছিল, যা এখন স্তিমিত হতে হতে মিলিয়ে গেছে নইলে ওই
ব্যাবস্থাপনায় কিছু একটা ঘটে যাবে বা কপালগুণে লেগে যাবে এই আশায় থাকার অবকাশ মুছে
ফেলার দুঃখ থাকার কথা ছিল না। সওগাত ওই বড়ো ছেলের চাকরি বাবদ এক ভদ্দরলোককে
(বাঙালি ভদ্দরলোক; আমরা যেন বাঙালি নই, কিন্তু আমরা তা মনে করি না, বা বলি না,
এমনকী ওরাও আমাদের বাঙালি বলে মানতে চায় না -- বলে মুসলমান) কুড়ি হাজার টাকা আগাম
দিয়েছিল। সে নাকি এপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে ধরিয়ে দেবার পর ওই এমাউন্টটা ফেরত দিত।
কিন্তু দিন যায়, মাস যায়, সেই অফিসার নাকি অফিসে আসে না। তারপর তার মৃত্যু ঘটে যায়
আচমকাই। ফলে কুড়ি হাজার টাকার মায়া সেই ভদ্দরলোক শারীরিক ভাবে হাওয়া হয়ে যাবার
সঙ্গে সঙ্গে ফুরিয়ে যায়। আরেকবার সওগাতের বড়ো ছেলে পুলিশের রেলিতে অংশ নিয়েছিল।
ঠিকঠাক চলছিল বেশ কয়েকদফা, তারপর যেই ফাইনাল সিলেকশনের কাছাকাছি এল অমনি বলা হল, ‘তোমার নামে গণ্ডগোল আছে।’
--কী গণ্ডগোল?
--আলিটা কোত্থেকে এল? তোমার নাম দেখছি সার্টিফিকেটে রুস্তম মণ্ডল। অথচ এখানে
দেখছি রুস্তম আলি মণ্ডল। এটা ঠিক করে আনো।
--স্যার আপনারা তো রেশন কার্ড দেখে নাম লিখেছেন, যারা রেশন কার্ড ইস্যু করে
তারা যদি ভুল করে - আমাদের দোষ কী?
--ঠিক করাও নি কেন?
--রেশন কার্ড ঠিক করা কি মুখের কথা? ভোট-টোট থাকলে না হয়, করানো যায়। তা এবারে
ভোটে জয়জয়কার বলে পাল্টানোর জন্যে দরখাস্ত তো করেছি স্যার!
--অত কথা শোনার সময় নেই। কাল বা পরশুর মধ্যে আলিটাকে ডিলিট করে না আনলে
পেন্ডিং পড়ে থাকবে।
--তাহলে কি স্যার অন্য কেউ পেয়ে যাবে চাকরিটা?
স্যার রুস্তমের ভ্যাবলাকান্ত চোখমুখের দিকে চেয়ে নিজেও ভ্যাবলাচণ্ডি মেরে যান--
নামের মধ্যে সামান্য আলি থাকা বা না থাকার জন্যে একটা জীবন হেরফের ঘটে যাবে এটা কি
তার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকে? আমরা জানি না কেননা, আমাদের বংশে বা চৌদ্দপুরুষে কেউ
কোনোদিন ওরকম পোষ্টে বসে কাউকে চাকরি দেওয়ার দায় নেয়নি বা নিতে পারেনি।
এসব কথা রৌশন বিবির বা তার পিসিমা ওরফে খুড়-শাশুড়ির জানার কথা না। তারা তাদের
বিতর্ক বা প্রতিদিনের ঝগড়া তারপর অন্য খাতে বয়ে নিয়ে যাবার ভাবনা গুছিয়ে আনার
চেষ্টা করে।
সওগাত তারপর সারাদিনে হেথা হোথা ঘুরে তার সাইকেলে, যার শরীর ভীষণ কাহিল হওয়া
সত্ত্বেও তার মালিক যখন চাপে তখন তাকে গন্তব্যে পৌছে দেয়ার এমন এক দায়, যে নিজের
পীড়া অগ্রাহ্য করে শরীরে ক্যাঁচোর কোঁচোর ইত্যাদি নানারকম আওয়াজপূর্বক সওগাতকে পৌছে দেয় তার বাড়িতে। বাড়িতে সওগাত
পৌঁছোয় মাটির দিকে তাকিয়ে। বস্তুত সওগাত কখনও কোনো পাশ কাটিয়ে যাওয়া মানুষের সঙ্গে
কথা বলছে বলে কেউ শোনেনি। ইদানিং এলাকায় দ্রুত উন্নয়ন হওয়ায় চারপাশে রঙিন
প্রজাপতির দল যখন ডানা মেলে হাফ শরীর ঢেকে গন্ধ ছড়িয়ে যায়, তখন যুবকরা তো বটেই
যাদের বয়স আমাদের মতো তারা একাধবার ওই পরম স্বর্গীয় শরীরি দৃশ্য না দেখে থাকতে পারি
না। সওগাত কিন্তু ওসব দিকে কোনো গুরুত্ব দেয় না। সে জানে ওসব হল মায়া, ছলনার জগৎ।
সাইকেলের দু-দিকের হ্যাণ্ডেলে দুটো চটের বোঝা, ক্যারিয়ারে একটা মোটঘাট, আর
ফ্রেমের কাঁকে একটা বোঝা, যাতে চালাতে অসুবিধা না হয়, এভাবে মাল-মালাদি নিয়ে উঠোন
পেরিয়ে ঘরের দেওয়ালে হেলান দিয়ে সাইকেলটা রেখে এক এক করে বোঝাগুলো খুলতে থাকে।
সওগাতকে তখন যদি নিরীক্ষণ করি তাহলে দেখব, তার কপালে গাঢ় এক চিন্তার ভাঁজ যা
কালকের থেকে কিঞ্চিৎ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়িতে আরও কিছু সাদার
প্রকোপ, যে জামাটি ১৯৮০ সালে সওগাতের শ্বশুর বেঁচে থাকতে ইদে গিফট করেছিল তার
প্রিয় জামাইকে, পরনে সেই জামা যেটি এই কুড়ি বছরে তোলা থেকে আটপৌরে হওয়ার মানসে
আলমারির বিষকপ্পুর গন্ধ ছেড়ে আলনায় ঠাঁই নিয়েছে, কিন্তু সওগাতের চেহারার বিন্দুমাত্র
পরিবর্তন না হওয়ার কারণে ফিটিং একই-- সঙ্গে একটা নীল চেকের লুঙ্গি। পায়ে কবে সাবান
মেখেছিল তা মনে নেই। সে কারণে ফাটা গোড়ালির চাপে জেরবার একখানা প্লাসটিকের চপ্পল,
যা বেঁকে দুমড়ে জাপটে ধরেছে দুটো পা-ই। নেহাত ছটকা না মারলে যেদুটো খুলে যাবার জো
নেই। ওজুর সময় পা ধুতে গেলে ভারি বেকায়দা। পাশে বসা ওজু করার লোকটা জিজ্ঞেস করে, ‘ওরম পা ছটকাচ্ছ কেন
বলোদিনি পাঁঠার মতো! পায়ের পানি মাথায় উটতেচে।’
সওগাত তখন ওজুর দোয়া পড়ায় ব্যস্ত। সেটা শেষ হলে জুতসই জবাব দেবে কী, ওদিক থেকে
একজন মুসুল্লি বলে ওঠে, ‘আঃ মসজেদে ওসব তর্কবিতর্ক নয়।’
তখন ঘড়িতে দুপর তিনটে বাজবে। একটু পরেই আছরের আজান হাঁকবে। তার মধ্যে গোসল আছে
খাওয়া আছে। মালের দর ঠিকঠাক নিল কি না তা জাজ করা আছে। তবে সওগাতকে দুটো পয়সা ঠকানো
সহজ নয়। ঠকবে না বলেই না পনেরো কিলোমিটার ঠেঙিয়ে মাল গস্ত করে আনা খোদ চাষির কাছ
থেকে। হ্যাঁ, পাইকারি বাজারে তো যেতেই হবে। কিন্তু চাষের মালের কদর আলাদা। প্রমোটারের
কবলে যাবার আগে নিজের জমিজিরেত যখন ছিল তখন সদ্য ফোটা ফুলকপি, শিশিরে ভেজা
ধনেপাতা, লক লক করে বেড়ে ওঠা পালঙ আজও ভেসে ওঠে চোখের সামনে। সওগাত সেই সবুজ
তীর্থক্ষেত্রের মতো আদিগন্ত সবজিবাগানের ঘ্রাণ আর স্পর্শ নেওয়ার জন্যেও কি অতদূর
হাঁটে না!
আছরের নামাজ শেষ হলে বাজারে পরিপাটি করে প্লাসটিক বিছিয়ে তার ওপর ভারী চট
বিছিয়ে গদি মতো এমন করে, যার ভেতর বিক্রির টাকাপয়সা রাখা যাবে -- চারদিক সমান করে
মালপত্তর রেডি করে বসে পড়বে।
ততক্ষণ রৌশন বিবির বসে থাকলে চলবে না। ভোর থেকে রাত্রি অবধি, যতক্ষণ না বেহুলা
শুরু হচ্ছে টিভিতে ততক্ষণ কাজের শেষ নেই। এক জা সর্বক্ষণ টেরিয়ে টেরিয়ে দেখে যাবে
রৌশনের মতিগতি। তারপর মুখ বেঁকিয়ে তেমন এক সখা পেলে বলবে, ‘দেখ, মুরগির পা কামাই
আচে তো এনার পা কামাই নি। কীজন্যি এত হিঁচড়ে মরিস? জমি বিক্কিরির এককাঁড়ি টাকা
ব্যাঙ্কে পচতেছে। এখনো চারকাটা জায়গা রাস্তার ওপরে, পোমোটরের দে দিলি তোদের পয়সা
খায় কে? তেমু দেখো, পোঁদের কাপড়টার দিকি চেয়ে দেকো, রাজ্যির সেলাই আর মোলচামড়া।
ফকিরগা অবস্তা ওর চেয়ে ভালো।’
এসব কথা আমাদের বহুশ্রুত। কিন্তু আমরা কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে খবরদারি করে
বলতে পারি না তোদের শিখিয়ে পড়িয়ে দিতে চাই, যাতে তোমরা অসভ্য থেকে সভ্য হও। সওগাত
চাচা বা রৌশন বিবি বা আমাদের গ্রামের অপরাপর বাসিন্দা যারা নিজেদের মতো জগৎ রচনা
করে ইহকাল আর পরকাল নিয়ে দিন গুজরান করছে, তারা কি কেউ চাইছে, কোনো বহিরাগত সাহায্য। মানুষের কাছে আমাদের চাহিদা কী থাকতে
পারে। সমাজ কি কোনো সমাধান দেয়? আমরা তাই দ্বীনের পথে সেসব সমস্যা মোকাবিলার জন্য
প্রস্তুত থাকি।
রৌশন বিবি সেই আছরের সময়ে তার মোলচামড়া বলো বা তাপ্পিমারা কাপড়ই বলো, ভালো করে
কোমরে সেঁটে বেরিয়ে পড়ে কোনো বাগান সংলগ্ন বাড়ির দিকে। সে বাগান হয়তো বহুদিন পড়ে
আছে। অথবা কোন ধনী ব্যক্তি কিনে রেখে দিয়েছে, ভবিষ্যতে যখন এখানে মেট্রোরেলের
স্টেশন হবে, তখন মালটিস্টোরিড করে দেদার পয়সা কামাবার মানসে--। যেখানে প্রকৃতির
নিয়মে গাছেরা পাতা ঝরায়, ডাল শুকনো হয়ে ভেঙে যায়, রৌশন বিবি সেগুলো একটা একটা করে
দড়ি দিয়ে গুছিয়ে বাঁধে। তারপর তুলে নেয়
মাথায় কিংবা কাঁখে। এবার বাড়ির দিকে যাত্রা। পথে তার তীক্ষ্ণদৃষ্টি থাকে মাটির
পানে। আবার টনটনে নজর রাখতে হয় আশপাশে, যাতে চেনা মানুষ না সামনে পড়ে যায়। পথ করতে
হয় শর্টকাটে। হয়তো তার পাশ কাটিয়ে ফিরে
আসছে টুপি মাথায় কোনো নামাজি বা নামাজির দল, তারা অবাক বিস্ময়ে হয়তো দেখছে সওগাত
মিঞায় বিবির কাণ্ড। কিংবা সবিস্ময়ে তারা চিনতে চেষ্টা করছে এ কোন বাড়ির বউ রে ভাই
এভাবে পরনের কাপড় মাথায় তুলে এমন ঠ্যাং বের করে কাঠকুটো মাথায় নিয়ে যায়। নাউজুবিল্লাহ
! মুসলমানের বউ একটু পরদা নেই।
পরদা থাকলে হয়তো সেদিকে দেখতেন না নামাজি মানুষটা। কিন্তু উদোম পায়ের থেকে
দৃষ্টি ফিরিয়ে থাকা যে ভীষণ মুশকিল এ নিয়ে নামাজিটির দ্বিধা অতঃপর কারবালার
ময়দানের মতো অন্তহীন হয়ে ওঠে।
সেইসব কাঠকুটো বাড়ি অবধি বেঁধে-লুটিয়ে টেনে আনতে আনতে পথে একসময় ধুলোর ওপর যে-দাগ
পড়ত তা আজ পিচ রাস্তার দৌলতে অন্তর্হিত থাকলেও রৌশন বিবির জোগাড়-যন্তরের কোনো হেলদোল
হয়নি। সেই সব জ্বালানি এরপর কেটে ফালি ফালি করে তাড়া বাঁধতে বাঁধতে এশার আজান পড়ে।
ফের সকালে উঠে সেগুলির মধ্যে ওস পড়ে কি বর্ষার পানি পড়ে সারারাত ধরে ভেজে সেসব
মেলে দিতে হয় রোদে। তারপর কোনো এক সকালে চুলোয় জ্বালিয়ে দিলে সে আগুনের উল্লাস
দেখতে দেখতে নিজের শ্রম সার্থক হয়ে ওঠা দেখতে পায় রৌশন বিবি।
ওদিকে সওগাত মিঞা একটা একটা মশা মারার মতো ফুটের সবজির দোকানে একটা ষাট কি
চল্লিশ পাওয়ারের ডুমের নীচে একটা একটা খদ্দেরের সঙ্গে বেচাকেনা করে। না শুধু বেচে
চলে। এরই মধ্যে কখন যেন মগরিবের আজান হয়। আল্লাহর ডাক, তাকে এড়ায় কী সাধ্যি
সওগাতের। কিন্তু তখন দোকান সবে খুলে বসা, বন্ধ তো করা যা না। তবে উপায় আছে
সওগাতের। যিনি আমাদের রুজি দিয়েছেন তিনিই তা রক্ষা করেন। তাঁর ডাকে সাড়া দেয়ার
কালে তিনি তো অবশ্যই দেখবেন। ওই তো মদিনা শরিফে,
ফি ওয়াক্তে নামাজের সময় কোনো দোকানি কি দোকানের ঝাঁপ টেনে দেয়? দেয় না। সোনা বলো,
হিরে-জহরত বলো সব অমনি এলো পড়ে রইল। কেননা সে-দেশে চোরই তো নেই। চুরি করলে হাত
কবজি থেকে নুলো করে ছেড়ে দেবে। এখানে, আমাদের কদমতলা গাঁয়ে হাত কাটার বিধান না
থাকলেও আল্লার ডাকে সাড়া দিতে, আল্লার ভরসায় ছেড়ে রেখে যাওয়া কি যায় না? সুতরাং
সওগাত এবার তড়িঘড়ি করে তার কাঁধের গামছা বিছিয়ে মাল-মালাদি চাপা দিয়ে নামাজের দিকে
ধাবিত হয়। তারপর সমস্ত এলাকা যখন শুনশান হয়ে যায়, যখন নাকি এলাকায় সকালের বাজারের
গিজগিজে ক্রেতার আনাগোনা সম্পর্কে ঘোর সন্দেহ জাগে তখন সক্কলের শেষে, আর দুজন
দোকানির সঙ্গে পড়ে থাকা মালের ওপর দুঃখের শ্বাস ফেলে গুছিয়ে উঠতে থাকে পর দিনের জন্য।
তখন হয় তো ঘড়িতে এগারোটা। তখন হয়তো ফিরতি পথে কোনো ড্রাইভার বা খালাসি তার সদ্য
বিয়ে করা বউয়ের ফোন মারফত জানতে পারা আর্জেন্ট সবজি বাজার তলানি থেকে সংগ্রহ করার
আগ্রহে সাইকেল স্টাণ্ড করছে। সওগাত হয়তো তার চোখে নতুন দাম্পত্যের উত্তেজনা দেখতে
পায় না। সওগাত দাম কম না করেই সৎকারের পূর্বেকার সবজিগুলো একে একে মেপে কিংবা নেহাতই থাউকো ধরে দিয়ে দাম
নেয়।
রাতে রৌশন বিবিকে দিয়ে গা-হাত টেপানোর ইচ্ছে জাগলে রৌশন বিবি ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘আমার গা-গতর কে টিপে
দেয় ঠিক নি।’
সওগাত ভেবে দেখে কথাটা মন্দ বলে নি। তার সুযোগ্য বিবি তারই মতো সমানতালে
সংসারে শ্রম দিয়ে চলেছে। কবে যে একখানা শাড়ি কিনে দিয়েছিল? না, মনে পড়ছে না। তবে
শেষবার মেয়েটা পেটে থাকতে যে সবুজ কালারের শাড়িটা কিনতে ফ্যান্সি মার্কেটে গিয়েছিল
সেটা ভোলে নি। কেননা ওই শাড়িটা খুব মানাত রৌশন বিবিকে। ভারি শাড়িটা পেটে থাকা সাড়ে
তিন কিলো বাচ্চাকে এমনভাবে ঢেকে রাখত যে কারো বোঝার উপায় ছিল না।
এইসব ভাবতে ভাবতে প্রতি রাতে প্রতি দিনে আবার প্রতিটি ভোরের পর পর সওগাতের বয়স
বাড়ে। সে জানে তার ব্যাঙ্কে কত ব্যালান্স। অথবা জানেই না তা বেড়ে বেড়ে, নিন্দুকের
কথায় ফুলে ফেঁপে কত মোটা অঙ্কে দাঁড়িয়েছে। সে জানে সেই সঞ্চয় থেকে সে একটি
নয়াপয়সাও খরচ করেনি। কেবল বৎসরান্তে সুদের টাকা নিয়ে ফকির মিশকিনকে বিলি করে দেয়,
নয়তো হারাম গ্রহণ হয়ে যেত। অথচ বহুদিন আগের ভাগে পাওয়া একটুকরো জমিতে (আর সবাই হু
হু করে বেচে দিলেও সে ধরে রেখেছিল ওই চারকাঠা ) প্রমোটার বাড়িটা আজও বানাতে পারল
না। পারলে আরও লাখ বিশেক এক্ষুনি ব্যালেন্সে জুড়ে যেত দপ করে জ্বলে ওঠা মাঝরাতের
রোশনির মতো।
কিন্তু- -
কিন্তু তার লাইফের ওঠাপড়ার কোনো গ্রাফ কি তৈরি হয় না তার অজান্তে। নাকি সেসব
ভাবনা আমাদের হতে পারে, তার যেমন চলছে তেমন চলতে পারলেই হল!
এমন একেবারেই নিজের মধ্যে না তাকানোর কোনো এক সন্ধ্যায় হঠাৎ মাইকে একটা ঘোষণা
সওগাতের কানে আসে। প্রথমটায় খেয়াল করার দরকার মনে করেনি। কেননা, সে জানে মাইকের
হাঁকাহাঁকিতে ওসব ফাংশনে বলো আর আর মলম ঔষধ বলো কিম্বা লটারির টিকিট, ওসবে কিচ্ছু
হয় না। তার নিজের কাজ যেমনকার তেমন চলে। অথচ এ-ঘোষণা যেন কানে খট করে লাগে। তার
ছোটো মেয়ের নাম শোনা গেল না! তাকে নিয়ে কী বলা হচ্ছে? একি চালবাজি কারবার?
কিন্তু না, সত্যিই সওগাত এবার শুনল, একটি চোদ্দো বছরের মেয়েকে আজ ভোর থেকে
পাওয়া যাচ্ছে না, উচ্চতা পাঁচ ফুট গায়ের
রঙ মাঝারি তার পরনে...সওগাতের হাতের কাজ থেমে যায়। মাইকের ঘোষণা আবারও বলে, কেউ
যদি সন্ধান দিতে পারে তাহলে নগদ পুরস্কৃর করা হবে... অসম্ভব,
অসম্ভব! মনে মনে বলে উঠল সওগাত। তার মেয়ে অথচ সে জানে না হারিয়ে গেল কি না! আচ্ছা
সত্যিই কি সে কোনোদিন খোঁজ নিয়ে দেখেছে, ছেলেমেয়েরা কে কোথায় আছে, কী তারা খাচ্ছে,
কীভাবে তারা মানুষ হচ্ছে? মনটা তার হু হু করে উঠল। কীসের জন্যে সওগাত তাহলে মুখে
রক্ত তুলে খেটে মরছে!
তাই বলে পুরস্কারের টাকাটা দিতে হবে,
কে দেবে? আমি? হারগিস না। আমার পারমিশন নেয়ার দরকার মনে করল না কেউ। আমি বিশ্বাস
করি না এসব ঘটনা। ঘটতে পারে না এসব।
ঠিক তখনই মাইক অলা রিকশাটা কাছে এসে দাঁড়াতে তা থেকে সওগাতের সামনে নেমে
দাঁড়াল বড়ো ছেলে। তার চোখেমুখে আতঙ্কের আঁচ দেখে কিছু বলা হয়ে ওঠে না। মাইক আপাতত
শান্ত রয়েছে। যে ছেলেটা এনাউন্স করছিল সে মাউথপিস ধরে বোকার মতো এদিকে তাকিয়ে
বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করছে। তবে রিকশা ঘিরে অশান্ত মানুষের ভিড়। বেশ রসালো খোরাক
পাওয়া গেছে। এরপর বাপ-বেটার কী পরামর্শ হয় তা শুনে রাখা দরকার।
পিতার ক্রোধী চোখমুখে চোখ রেখে কথা বলা বড়োছেলের বিমর্ষ মুখের পক্ষে বেশ
মুশকিল। কিন্তু যা বলার তা তো বলতে হবে। তার হাতের মোবাইলটা পিতার হাতে ধরিয়ে দিয়ে
বড়োছেলে বলল, ‘আব্বা, এই মাত্র খবর পাওয়া গেল টিনাকে ধরে রেখেছে সইদুল। এই নাও কথা বল -’
কে সইদুল? সে কীজন্য
টিনাকে ধরে রেখেছে? কী চায়? এরকম নানা জিজ্ঞাসা কিছুটা বলে, কিছুটা মনে রেখে,
কোনোদিন সেলফোনের স্পর্শ না-পাওয়া সওগাত এইমাত্র সজাগ হল ওপারের বার্তায় :
--চাচা, সালাম আলেকুম। আপনার মেয়ে টিনা আমার কাছে মহা সুখে আছে ইনসাআল্লাহ। কথা বলবেন তার সঙ্গে!
--কে তুমি? টিনা ওখানে গেল কেন? সওগাতের ক্রোধ দ্বিগুণ হয়ে ওঠে।
--এই, তুই সইদুলকে চিনলি কী করে আঁ? তার ফোন এল তোর কাছে কেন? প্রশ্নটা বড়ো
ছেলের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে আবার কানের কাছে চেপে ধরল ওপারের কোনো বার্তার অপেক্ষায়।
কিন্তু টিনা তার পিতাকে যেটুকু কথা না বললে নয় তা শেষ করেছে। এবার সইদুল বলে, ‘একটু আগাম হয়ে গেল
ব্যাপারটা চাচা। না, এখনই বিয়ে করতে চাই না। তবে কাল দুফুরের মধ্যে লাখ খানেক টাকা
যদি দেন তাহলে কথা রাখতে পারি - নয়তো--’
থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে আমার চাচা। এ কী শুনছে। তার এতদিনের স্বপ্ন, আশা আকাঙ্খা সব
বিফলে যাবে? আশ্চর্য, এই প্রথমবার সওগাতের মনে হল তার স্বপ্ন আশা আকাঙ্খার কোনো
স্পষ্ট অবয়ব নেই। কেন সে বেঁচে আছে, জগতে কী করার জন্যে আল্লাহ তার মতো মানুষদের
পাঠিয়েছে কিছুই ভালো করে জানা হয়নি। যেটুকু জেনেছে তাতে এই মুসিবত থেকে পরিত্রাণ
পাওয়ার কোনো রাস্তা বলা নেই।
ধপ করে বসে পড়ল সওগাত। মাটিতে। সবকিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল মাথার মধ্যে।
তার কন্যা, তার পুত্র, কেমন অদ্ভূতভাবে বেড়ে উঠছে তলে তলে, টের পায়নি। বেড়ে উঠছে
না ষড়যন্ত্রী হয়ে উঠেছে। সইদুল তাহলে উভয়রই পরিচিত। এতদিনের না-বোঝা, নাভোগ-করা
জমানো টাকা, অনাদরে বেড়ে ওঠা টাকাগুলো এবার কি তাহলে কাজে লাগবে? কাজে না অকাজে?
সওগাত ঠিক বুঝতে পারল না। মানুষের আসল চাহিদা কী? হাড়ভাঙা পরিশ্রমের জন্য বেঁচে
থাকা না ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য পরিশ্রম? নাকি জগতের সবকিছুই মায়া?
সওগাত ফোনটা ছেলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, মাইকটা বন্ধ করতে বলো। তারপর মগরিবের
নামাজে যাবার মতো গামছা চাপা দিয়ে নয়, দোকান দেখবার জন্য কাউকে বলেও নয়, ছেলেকে
দাঁড় করিয়ে রেখে উঠে পড়ল ফুটের দোকান ছেড়ে। বলল, ‘বড়ো দায়-ঠেকায় ফেলে দিলে বাবা তোমরা। আমি একটু ঘুরে
আসি বাড়ির দিক থেকে, কেউ এলে দেখো...’
বড়ছেলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল দোকানের সাজানো-গোছানো মাল-মালাদির দিকে। বাঁধা
খদ্দেরের আনাগোনা শুরু হয়েছে। নানা প্রশ্ন করছে তারা। আব্বা এতসব সামলাত কী করে?
ভাবল সে। কোনোদিন তার মনেই হয়নি এতবড়ো এক পৃথিবীর মতো সংসার টানতে হলে একজন একা
মানুষকে কী কী করতে হয়। মাইকে বসা ছেলেটির দিকে এবার গেল সে। তাকে কিছু টাকা দিয়ে
বলল, ‘তুই চলে যা। যা হবার
হবে, কাল দেখা যাবে।’
তারপর গুটিগুটি গিয়ে বসল সেই আসনে,
যেখানে বসে সওগাত চাচা দিনের পর দিন সাঁঝের পর সাঁঝ একটা একটা মশা মারার প্রতীক্ষা
নিয়ে নিজেকে ফুরিয়ে ফেলত।
*******
Comments
Post a Comment