Skip to main content

সংহতি মজুমদার


অজানা কারণ

প্রণববাবু বড়ই ভালমানুষ। একমাথা কোঁকড়া চুললম্বা চওড়া স্বাস্থ্যচোখ দুটি নিস্তেজ। দুর্গাপুরের বাসিন্দা তিনি। তাঁর বাড়িতে স্ত্রীএক ছেলে ও এক মেয়ে। তিনি গলসির একটি স্কুলের শিক্ষক। বাড়ি থেকে তাঁর স্কুলে যেতে সময় লাগে দেড় ঘন্টা। ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেন। ছটায় বেরোন আর বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় বিকেল পাঁচটা। ফিরেই টিউসন।
এক বছর হল প্রণববাবুর সময়টা ভাল যাচ্ছে না। সাংসারিক অশান্তিতে জেরবার হয়ে যাচ্ছেন। স্বভাবে তিনি এতই ধীরস্থির যে বাইরে উঁচু গলায় কথাও বলেন না। বাড়িতেই যা একটু হম্বিতম্বি করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাঁর ছেলেমেয়েরা তাঁকে ভয় পায় না। তাঁর স্ত্রীও নিপাট ভালমানুষ। তাঁদের মেয়েটি এখন ক্লাশ নাইনে পড়ে। পড়াশুনায় খুবই  ভাল ছিল কিন্তু ইদানিং সে পড়াশুনাই করছে না। তাতে প্রথমে প্রণববাবু চিন্তিত হন নি কিন্তু তাঁর কপালে চিন্তার রেখা দেখা দিল তখন যখন একদিন তিনি মেয়েকে টিউসন থেকে আনতে গিয়ে দেখলেন পাড়ার এক বাজে ছেলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে তাঁর মেয়ে হাসাহাসি করছে। বাড়িতে এসে মেয়েকে প্রশ্ন করাতেই মেয়ে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে বলল, ছেলেদের সাথে কথা বললেই প্রেম হয়ে যায় না।' এতে মা বাবা নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন সাময়িকভাবে  কিন্তু দিনের পর দিন সেই ছেলের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেল। সেই ছেলেকে প্রতিটি টিউসনের সামনে, স্কুলের সামনে দেখা গেল। মোবাইলে ফোন ও এস-এম-এস আসা বেড়ে যাওয়ায় প্রণববাবুর স্ত্রী কান্নাকাটি জুড়ে দিলেন কিন্তু মেয়ের মধ্যে তাতে কোন পরিবর্তন এল না। যন্ত্রণায়  তিনি ভেঙে পড়লেন।

প্রণববাবুর ছেলের নাম পরশ। দু-দুবার জয়েন্টে পাশ করতে না পেরে পাশকোর্সে কলেজে ভর্তি হয়েছে। এ জন্য সে একটু ডিপ্রেশানে ভুগছে। আর বারবার দোষারোপ করছে বাবাকে। সে অভিযোগ তুলছে-আমাকে প্রথম থেকে ভাল টিউশানি দাও নি কেন তোমরা’? ছেলেকে নিয়ে এখনও অনেক স্বপ্ন প্রণববাবুর। তিনি ছেলেকে বোঝান যে, সব শেষ হয়ে যায়নি। এখনও ভবিষ্যৎ গড়ার সময় আছে। কিন্তু তবু বাবার প্রতি তার ক্ষোভ কমে না। সে জানিয়ে দেয়-আমি কোন প্রফেসনাল কোর্সে ভর্তি হতে চাই। যত টাকাই লাগুক।' প্রণববাবু বোঝাবার ভঙ্গিতে বলেন, ‘আগে গ্রাজুয়েটটা হয়ে নে তারপর না হয়...’ কিন্তু ছেলে চায় এখনই ভর্তি হতে। এই মতবিরোধ দুজনের মধ্যে একটা দূরত্ব সৃষ্টি করে  চলে।                                                                                                             

আজ বুধবার। স্কুলে যেতে ইচ্ছে করছে না প্রণববাবুর। কিন্তু শুধু শুধু না গিয়েইবা কী করবো’ -ভাবলেন তিনি। মাথার বাঁ-দিকটা একটু যন্ত্রণাও করছে। তবু খাট থেকে নেমে তিনি জোর করে তৈরি হতে শুরু করলেন। যথাসময়ে বাস এল। বাসে প্রচন্ড ভিড়। কোনরকমে দাঁড়াতে পারলেন। বাস চলতে শুরু করার কিছুক্ষণ পরেই একটা লরির সঙ্গে ধাক্কা লাগে । তাতে আধ ধন্টাখানেক দেরি হয়ে যায়। একটু পরেই ওর পাশে দাঁড়ানো এক মহিলা চেঁচিয়ে বলে উঠলেন-মশায়,ঠিক করে দাঁড়াতে পারছেন না। অসভ্যের মত দাঁড়িয়ে আছেন।' প্রণববাবু খানিকটা ভ্যাবাচাকা খেয়ে নিজেকে আরো গুটিয়ে নিলেন। লজ্জায় মিশে যাচ্ছিলেন তিনি। বাসটা কিছুদূর যেতে না যেতেই আবার ওই মহিলার চেঁচামেচি- আমার পার্স-আমার পার্স কোথায়?-এইযে ইনি-ইনিই হবেন। তখন থেকে গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এইযে মশাই আপনার কথাই বলছি’ সোজাসুজি প্রণববাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি। আকাশ থেকে পড়লেন প্রণববাবু। বললেন, ‘আমি! কী বলছেন আপনি? আমি আপনার পার্স নিলে এখানে কি এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতাম?’ মহিলা আর কিচ্ছুটি বললেন না। প্রণববাবু অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন, কেন ভদ্রমহিলা এ ধরণের আচরন করতে গেলেন! কিন্তু কোন কিনারা পেলেন না। ইতিমধ্যে স্কুলের স্টপেজ এসে গেল। যখন তিনি নামলেন-শারীরিক ও মানসিকভাবে একেবারে বিধ্বস্ত। এদিকে স্কুলে ঢুকতে না ঢুকতেই দেরি হওয়ার জন্য হেডস্যারের ভর্ৎসনা জুটলো তাঁর  কপালে। প্রথম পিরিয়ডে ক্লাশ থাকায়-ওই অবস্থায় ঢুকতে হল ক্লাশে গিয়ে। একটু বসে দম নিয়ে- তিনি পড়াতে শুরু করলেন। সঙ্গে সঙ্গে একটি ছাত্র তার বন্ধুকে গুন গুন করে একটা হিন্দি গান শোনাতে শুরু করলো। প্রণববাবু তাকে দেখে ফেলে সোজা জিজ্ঞেস করলেন,
-‘গান করছিলে কেন?’
ছেলেটি সটান বলে দিল, ‘আমিতো গান করিনি।' 
-করনি মানে? আমি নিজের চোখে দেখলাম
-আপনি ভুল দেখেছেন
-এ্যাই, বেরিয়ে যাও ক্লাশ থেকে।
-আপনি জানেন আমি সেক্রেটারির ছেলে?
-যারই হও, বেরিয়ে যাও।
- আমি ক্লাশেই থাকবো।বেরোব না।
কী! বেরবে না’! বলেই তিনি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে টেবিল থেকে ডাস্টারটা তুলে ছুঁড়ে মারলেন। সেটি গিয়ে লাগল ছেলেটির কপালে। কেটে রক্ত পড়তে লাগল। চারদিকে হৈ-চৈ পড়ে গেল। ছাত্র শিক্ষকের ছোটাছুটি শুরু হল। গেমস্‌ টিচার ফার্স্ট-এড বক্স নিয়ে দৌড়ে গেলেন। হঠাৎ- যেন মাটি ফুঁড়ে- উদয় হল স্থানীয় চ্যানেলের সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফার। পরদিন কাগজের ২য় পাতায় খবর ছাপা হলঃ গলসি স্কুলের শিক্ষকের প্রহারে ছাত্রের মাথা ফেটে রক্ত’! এবং তারপরেই প্রণববাবুকে দেখা গেল লক-আপে।
 বাড়িতে তাঁর স্ত্রী নিঃশব্দে কাঁদছেন। ছেলে পরশেরও  চোখদুটি বারবার ভিজে উঠছে।**

Comments

Popular posts from this blog

আলী হোসেনের ছোটগল্প। এক এক্কে এক।

এক এক্কে এক : ছোট্ট বেলা নামতা পড়ার সময় এভাবেই শুরু করত মান্তু। তখন জানতো না কি এর মানে, কেনই বা পড়তে হয়। মা বলতেন, নামতা হল অঙ্কের মাথা। কিম্বা মেরুদণ্ডও বলতে পারিস। এটা ঠিকঠাক না শিখলে অঙ্ক মেলে না। যখন প্রাথমিক স্কুল ছেড়ে মাধ্যমিকে পৌছেছে, তখন মায়ের কথার মানে বুঝেছে মান্তু। কিন্তু পরিণত বয়সে এসে, আজ বুঝেছে এর অন্য মানে। এটা না জানলে, জীবনের মানেটাই পালটে যায়। মিলতে চায় না জীবনের অঙ্কটাও। মান্তু তখন ক্লাস এইটে। হঠাৎই দুঃসংবাদটা এলো। ক্লাসে সেলাই দিদিমনি, ফ্রেঞ্চনটের গীট ধরে আটকানোর চেষ্টা করছেন। বোঝাচ্ছেন, কিভাবে একে কব্জা করতে হয়। মান্তু কিছুতেই এই গিঁটকে কব্জা করতে পারছেনা। মাথার ওপর বোঁবোঁ করে ঘুরছে পাখা, অথচ ঘামের স্রোতে ভাঁটার টান নেই মোটেও। বাইরের বাতাসে উত্তাপের পারদ নিশ্চয়ই লু-লেবেল ছাড়িয়েছে। বাতাসের শুষ্ক বুকে তরঙ্গ তুলে সে ছুটে চলেছে শরীর জুড়াতে আন্য কোথাও, অন্য কোনখানে। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে চাঁদনি থেকে দোকানের মাল নিয়ে ফিরছিল ফারহাদ। হঠাৎই চরকির মত ঘুরে গেল মাথাটা। পিচ-গলা রাস্তায় আছড়ে পড়লো মস্ত শরীর। পথ-চলতি নজর চকিতে ঘুরে এল ফারহাদের দিকে। কে বলে কলকাতার হৃদয়ে উষ্ণতার অভা...

মুর্শিদ এ এম - এর গল্প। ঠুনকো।

পুরো গল্প পড়তে গল্পকারের নাম -এর ওপর ক্লিক করুন ।। হোম পেজ-এ যেত এখানে ক্লিক করুন audio testing গল্পকারের কণ্ঠে গল্প পাঠ।  ঠুনকো একের পর এক প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে একেবারে দক্ষিণে, মনে হচ্ছিল একটু গেলেই সাগর এগিয়ে আসবে, একলা ত্যাজ্যপুত্রের মতো দাঁড়িয়ে থাকা এক্সপ্রেস ট্রেনটা দেখতে পেল ইয়াসিন। সাউথ ইন্ডিয়া যাবার প্রায় সব ট্রেন এই দিকের প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়ে। বন্যার কারণে কয়েকটি ট্রেন বাতিল হওয়ার পর কদিন হল খুলেছে। একাই এতটা পথ লটবহর টেনে গলদ্ঘর্ম হয়ে কামরায় ঢুকে নিঃশ্বাস ফেলল সে। এখনও এ সি চলেনি। চললে অসুবিধেই হত, হঠাৎ লেগে যেত ঠান্ডা। নিজের সিট খুঁজে মালপত্র রেখে চোখ-মুখ ধুয়ে, টুপিটা খুলে আবার পরে নিয়ে, ঘন সুবিন্যস্ত দাড়ি ভেজা হাতে মুছে খানিকটা জল খেয়ে স্বস্তি পেল যেন। একটা কালো ঢাউস ব্যাগকে কিছুতেই কব্জা করতে না-পেরে পায়ের কাছেই রেখে দিল ইয়াসিন।

নয়ারুণ ভট্টাচার্য্য

রেবন্তর স্ববধবিলাস ‘No one ever lacks a good reason for suicide’         - Cesare Pavese (1908-50) কাল এক দীর্ঘ, দীর্ঘ রাত্রিব্যাপী পরিক্রমায় গৃহত্যাগ করিব। পরিক্রমার অন্তে দেখিব তরঙ্গবিক্ষুব্ধ এক অপার জলধি। মৃত্যু কী এমনই দেখিতে? ভাবিলেও রোমাঞ্চকণ্টকিত