Skip to main content

মুর্শিদ এ এম

তেরো থেকে একুশে পতনজনিত জটিলতার বয়ান

        গত চল্লিশ বছর ধরে তার কাছে থাকা চাবির গোছাটাকে যেমন চেনে বশির আলি, তেমন চেনে তালার একেকটা ছিদ্রকে। তালার ছিদ্রকে অবশ্য বশির আলি ছিদ্র বলে না। বলেনা, যা বলে ,তা ভদ্র সমাজে না উচ্চারণ করাই ভালো। করলে নিজেকে ডিক্লাসড করা যায় বলে মনে হলেও আদৌ তা সম্ভব হয় কি না সন্দেহ। তো বশির আলির এই চাবির গোছাই তার সম্বল। গোছার ভেতর নব্বই শতাংশ চাবিরই কোনো তালা নেই। অথবা থাকলেও কোনটার ভেতর কোনটা সেঁধোবে তা মনে করতে পারে না। কেবল খানতিনেক চাবি তার রোজকার ব্যবহারে লাগে। সকাল সন্ধে যে দোকানটা সে  চালায়, তার শাটারের জন্যে দুটো, আর ভেতরের গ্রিলের  জন্যে একটা। দোকানটার বিবরণ দেয়ার মতো কিছু নেই। কিচ্ছুই নেই। এই না-থাকাটাই তার প্রধান বৈশিষ্ট্য। জনসাধারণ এই দোকানটিকে রকমারি স্টোর্স নামে চিনলেও, ডাকে ঝকমারি স্টোর্স বলে। যখনই ক্রেতাসাধরণ কিছু কিনতে যান, তখনই বশির বলে দেয়নেই।
        সেই চাবিদুটো আর তার ইয়ে নিয়ে এক সন্ধেয় মহা জটিলতায় আক্রান্ত হয় বশির আলি। চাবি মানে বশির আলির কাছে অনেক কিছু। যতই দোকানটা শূন্য আর আরশোলার আড়ত হোক না কেন, তাকে প্রটেকশন দিয়ে রাখে। চাবির গোছা পাঞ্জাবির পকেটে থাকার সময়, সাইকেলে রওনা দেয়ার সময় অথবা মাথার কাছে রেখে শোয়ার সময় অদ্ভুত গভীর ভালোলাগায় আচ্ছন্ন করে। সবচেয়ে বশিরের আশ্চর্য লাগে, দুটো পেতলের লম্বা-লম্বা চাবির বিশ্বস্ততা। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর কেমন নির্দিষ্ট সময় মেনে দোকানের দুটো তালায় ঢুকে যায় এবং তাকে মুক্ত করে। যেন-বা বশিরের মুক্তির কারণও ঘটায়। চাবির এই মতাদর্শের কারণে বশির নিজেকে নিষ্ঠাবান রাখার প্রয়াস চালিয়ে যায়। তার মনে হয়, সকল মানুষের, সমগ্র মানব সমাজের এমনই এক মতাদর্শ নিয়ে চলা উচিত। 
        বহুবার ভুল করে একুশ নম্বর চাবিটিকে তেরোর ছিদ্রতে প্রবেশ করাতে গিয়ে দেখেছে , কী অভিমান! মিনিট পনেরো ধরে সেই অভিমান ভাঙিয়ে তবে তাকে উদ্ধার করেছে বশির। বাড়িতে ছমিরন বিবির কাছে সে কথা বলতে, অবশিষ্ট চারটি দাঁতের একটিতে ঘোমটার খুঁট চেপে সে কী হাসি!
       কোনো এক সন্ধেয়, যেদিন ওয়েদারটা নিজের ইচ্ছেমতোই চলছিল,আর বশিরেরও কোনো চাপ ছিল না, চাবি আর তার ছিদ্র নিয়ে তাকে আক্রান্ত হতে হল। 
        বশির দেখল তেরো নম্বর চাবিটা ভুল করে সে একুশ নম্বরের ছিদ্রে ঢুকিয়ে ফেলেছে। বশির নির্ঘাৎ জানত, এরপর টানাহেঁচড়া শুরু হবে। কিন্তু ওটার পুর্ণ অংশ সেঁধিয়ে যাবার পর অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করল, চাবির সঙ্গে সংঘাতে ছিদ্রের কোনো অভিমান তৈরি হচ্ছে না। তার বদলে সে ঢুকে যাচ্ছে অনায়াসে বিতর্কিত, এমনকী বিরোধী এলাকায়। 
        আকস্মিক এই ঘটনার জটিলতায় বশির কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হওয়ার আগে সে জানতে চায়, এই পরিণাম ঘটল কীভাবে? কীভাবেই বা তেরো নম্বর চাবিটি প্রতিকূল পরিস্থিতি জেনেও নির্বাচন করতে পারল একুশ নম্বর ছিদ্রকে? তবে কি তেরোর অন্তরে কোথাও গোপনে-গোপনে রেডি হওয়ার প্রস্তুতি পর্ব চলছিল? নাকি চাবির দাঁতগুলো ক্রমশ ক্ষয়ে-ক্ষয়ে উচ্চাকাঙ্খার স্বাদ পেয়ে গেছিল? বশির যা জানতেও পারেনি! বশিরের জ্ঞান লুপ্ত হল না। কেননা সে আপ্রাণ রত হল অভিমান ফিরিয়ে আনার চেষ্টায়। চেষ্টা করতে থাকল মতাদর্শগত বিচ্যুতি থেকে পরিত্রাণ দেয়ার।
        কিন্তু সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে তেরো নম্বর চাবিটি তেইশ নম্বরের ইয়েতে সেঁদিয়ে উদোম করে ফেলল যাবতীয় শৃঙ্খলা। এরপর বশিরের ঐতিহ্যশালী নেই-দোকানটির খোলা অথবা বন্ধ রাখার কোনো অর্থ বাকি রইল না।                 


Comments

Popular posts from this blog

আলী হোসেনের ছোটগল্প। এক এক্কে এক।

এক এক্কে এক : ছোট্ট বেলা নামতা পড়ার সময় এভাবেই শুরু করত মান্তু। তখন জানতো না কি এর মানে, কেনই বা পড়তে হয়। মা বলতেন, নামতা হল অঙ্কের মাথা। কিম্বা মেরুদণ্ডও বলতে পারিস। এটা ঠিকঠাক না শিখলে অঙ্ক মেলে না। যখন প্রাথমিক স্কুল ছেড়ে মাধ্যমিকে পৌছেছে, তখন মায়ের কথার মানে বুঝেছে মান্তু। কিন্তু পরিণত বয়সে এসে, আজ বুঝেছে এর অন্য মানে। এটা না জানলে, জীবনের মানেটাই পালটে যায়। মিলতে চায় না জীবনের অঙ্কটাও। মান্তু তখন ক্লাস এইটে। হঠাৎই দুঃসংবাদটা এলো। ক্লাসে সেলাই দিদিমনি, ফ্রেঞ্চনটের গীট ধরে আটকানোর চেষ্টা করছেন। বোঝাচ্ছেন, কিভাবে একে কব্জা করতে হয়। মান্তু কিছুতেই এই গিঁটকে কব্জা করতে পারছেনা। মাথার ওপর বোঁবোঁ করে ঘুরছে পাখা, অথচ ঘামের স্রোতে ভাঁটার টান নেই মোটেও। বাইরের বাতাসে উত্তাপের পারদ নিশ্চয়ই লু-লেবেল ছাড়িয়েছে। বাতাসের শুষ্ক বুকে তরঙ্গ তুলে সে ছুটে চলেছে শরীর জুড়াতে আন্য কোথাও, অন্য কোনখানে। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে চাঁদনি থেকে দোকানের মাল নিয়ে ফিরছিল ফারহাদ। হঠাৎই চরকির মত ঘুরে গেল মাথাটা। পিচ-গলা রাস্তায় আছড়ে পড়লো মস্ত শরীর। পথ-চলতি নজর চকিতে ঘুরে এল ফারহাদের দিকে। কে বলে কলকাতার হৃদয়ে উষ্ণতার অভা...

মুর্শিদ এ এম - এর গল্প। ঠুনকো।

পুরো গল্প পড়তে গল্পকারের নাম -এর ওপর ক্লিক করুন ।। হোম পেজ-এ যেত এখানে ক্লিক করুন audio testing গল্পকারের কণ্ঠে গল্প পাঠ।  ঠুনকো একের পর এক প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে একেবারে দক্ষিণে, মনে হচ্ছিল একটু গেলেই সাগর এগিয়ে আসবে, একলা ত্যাজ্যপুত্রের মতো দাঁড়িয়ে থাকা এক্সপ্রেস ট্রেনটা দেখতে পেল ইয়াসিন। সাউথ ইন্ডিয়া যাবার প্রায় সব ট্রেন এই দিকের প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়ে। বন্যার কারণে কয়েকটি ট্রেন বাতিল হওয়ার পর কদিন হল খুলেছে। একাই এতটা পথ লটবহর টেনে গলদ্ঘর্ম হয়ে কামরায় ঢুকে নিঃশ্বাস ফেলল সে। এখনও এ সি চলেনি। চললে অসুবিধেই হত, হঠাৎ লেগে যেত ঠান্ডা। নিজের সিট খুঁজে মালপত্র রেখে চোখ-মুখ ধুয়ে, টুপিটা খুলে আবার পরে নিয়ে, ঘন সুবিন্যস্ত দাড়ি ভেজা হাতে মুছে খানিকটা জল খেয়ে স্বস্তি পেল যেন। একটা কালো ঢাউস ব্যাগকে কিছুতেই কব্জা করতে না-পেরে পায়ের কাছেই রেখে দিল ইয়াসিন।

নয়ারুণ ভট্টাচার্য্য

রেবন্তর স্ববধবিলাস ‘No one ever lacks a good reason for suicide’         - Cesare Pavese (1908-50) কাল এক দীর্ঘ, দীর্ঘ রাত্রিব্যাপী পরিক্রমায় গৃহত্যাগ করিব। পরিক্রমার অন্তে দেখিব তরঙ্গবিক্ষুব্ধ এক অপার জলধি। মৃত্যু কী এমনই দেখিতে? ভাবিলেও রোমাঞ্চকণ্টকিত