সেতুবন্ধন
শুরু আর শেষ দৃশ্য অনেকটা একইরকম। অবশ্য দৃশ্যান্তর নানা রঙে ঝলমলে।
এখনোও উজ্জ্বল। সময় কাল ১৯৯০ সাল। আমি তখন
দশ বছরের। পঞ্চম শ্রেণী। নতুন স্কুল। নতুন নতুন বন্ধু। প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা হলেও
পরে পরে ক্লাসের সবার সাথে ভাব হয়ে গেল। স্কুলে আসা-যাওয়া এভাবেই ছয় মাস কেটে গেল।
অর্ধ-বার্ষিকী পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হল। আমি ক্লাসের মধ্যে ষষ্ঠ স্থানে রইলাম, তবে
বাংলায় সবচেয়ে বেশি নম্বর আমি পেয়েছিলাম দেখে ক্লাসের ফাস্ট বয় গৌতম কয়াল আমাকে
ডেকে বলল, ‘ব্যানার্জী, বাংলায় তুমি আমার থেকে ২০ নম্বর বেশি পেয়ে আমাকে চমকে দিয়েছো।
আজ থেকে তুমি আমার বেষ্ট ফ্রেণ্ড।’ সেই থেকে আমি ওকে গৌতম আর ও আমাকে ব্যানার্জী ডাকতাম।
প্রতিদিন টিফিন বক্স খুলেই দেখতাম সেই একই খাবার
– আটার রুটি আর আলুর তরকারি। রোজ রোজ একই খাবার খেতে ভাল লাগতো না। কিন্ত কি আর করা,
মা বলেন ‘আমরা গরীব, আমাদের এভাবেই চলতে হবে খোকা। তোমার বাবার ছোট মণিহারীর দোকান।
তুই বড় হয়ে চাকরী করে অনেক অনেক ভাল খাবার খেও আর আমাদের খাইও, এখন এটাই তোমার খাবার।’
একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরবার পথে বৃষ্টিতে প্রচণ্ড
ভিজে গেলাম। তারপর দিন থেকে কম্প দিয়ে
জ্বর। চার দিন স্কুল যাওয়া বন্ধ। সেদিন ছিল রবিবার। আমি তখন বাড়িতে বসে রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের কবিতা পড়ছি। এমন সময় একটি স্কুটার এসে থামল আমাদের বাড়ির কাছেই। আমি কিছু
বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ ও’ এসে চোখ দু’টো জাপটে ধরে বলল, ‘নাম বল, তবেই ছাড়বো।’ আমি মুহূর্তেই
বলে ফেললাম, ‘তুমি ব্যানার্জীর গৌতম।’ ও হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ল। বাবা আমাকে বললেন
– ‘কিরে মানু, বন্ধুকে কিছু খেতে দেবে না, শুধু গল্প করবে বুঝি।’ এই কথা বলেই বাবা
আমার হাতে দু’টি বিস্কুটের প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন। একটা প্যাকেট ওর হাতে দিতেই বলল
– ‘কাকু বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন, আজ আসি ব্যানার্জী। আজ ঘুড়ি কিনতেই হবে, সামনে বিশ্বকর্মা
পূজা। কাকুকে দশ বার বলেছি, খুব ভুল মন। আজ কিনেই ছাড়বো। কাল যেন তোমাকে স্কুলে দেখতে
পাই।’ এভাবেই আমরা খুব অন্তরঙ্গ হয়ে উঠলাম। আরও একদিনের কথা না বললেই নয়। সেদিন খুব
গরম পড়েছে। তখনোও স্কুলে গরমের ছুটি পড়েনি। সেদিন আমার টিফিন গরমে খারাপ হয়ে গেছে।
শুধু ওয়াটার বোতলের জল ছাড়া আর কিছুই খাওয়া হয়নি। তখন টিফিনের সময় শেষ হতে প্রায়
দশ মিনিট বাকি। ক্লাসের বাইরে এসে দেখি, গেটের বাহিরে ঘুগনির দোকানে খুব ভীড়। সবাই
ঘুগনি খাচ্ছে। আমারও খুব ইচ্ছা করছিল, কিন্তু কোনদিন মা’ আমার হাতে একটা টাকাও দেয়নি।
দেখি ওখানে গৌতমও আছে। তাকে দেখেই ছুটে গিয়ে ওর পাশে দাঁড়িয়ে গেলাম। ও বলল ‘কি বন্ধু,
ঘুগনি খাবে?’ আমি বললাম খাব। তৎক্ষণাত ওর পাতার ঘুগনির শেষ অংশটুকু আমাকে ধরিয়ে দিয়ে
বলল – ‘নাও খাও।’ আমি মুহূর্তেই সেটা শেষ করে বললাম, বন্ধু তুমি খুব ভাল, আর এক পাতা
কিনে দেবে বন্ধু, আমার খুব খিদে পেয়েছে। ও আরোও এক পাতার দাম দোকানদারের হাতে দিয়ে
মুখ নিচু করে একছুটে ক্লাস ঘরের দিকে চলে গেল। আমি খাওয়া শেষ করে এসে দেখি, ও টেবিলে
মাথা নিচু করে কাঁদছে। আমি বললাম, ‘আমি কি তোমাকে আঘাত দিলাম না জেনে!’ ও আমার হাত
দু’টো ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘ব্যানার্জী আমাকে ক্ষমা করো। আমি তোমাকে আজ আমার এঁটো
খাবার খেতে দিয়েছি। তুমি ব্রাহ্মণের ছেলে, বড় পাপ করেছি। আমার মা বলেন, তোমরা অনেক
উঁচু, তোমরা আমাদের নমস্য। আর আমি কিনা তোমাকে ছোট করলাম সবার সামনে।’ এইকথা বলে কাঁদতে
কাঁদতে আমার পা দু’টো
জড়িয়ে ধরল। আমি পা দু’টো ছাড়িয়ে নিয়ে বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘দূর পাগল,
আমরা বন্ধু। উঁচু-নিচু, ছোট-বড়, জাত-পাত আবার কি! বন্ধুর কোন উঁচু-নিচু নেই, একজন
আর একজনের জন্য সব সময় সব অবস্থাতেই। আমরা পরস্পরের হৃদয়ের অনুবাদ। এমন কথা আর কখনোই
মুখে আনবে না বন্ধু।’ সেই থেকে আমরা দু’জন হরিহর আত্মা। ক্লাসের সবার কাছে সেদিন থেকেই
আমি মধ্যমনি হয়ে উঠলাম। এভাবেই কেটে গেল ছ’টা বছর। আমরা মাধ্যমিক পাশ করলাম। উচ্চ
মাধ্যমিকে গৌতম ভর্তি হল বিজ্ঞান শাখার আর আমি বাণিজ্যে। তবে রোজই দেখা হত বাধ্যতামূলক
বিষয় ইংরাজি-বাংলার ক্লাস ঘরে। আর মাঝেমধ্যে টিফিনের সময় গৌতম আমার কাছে আসতো রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের কবিতার আবৃত্তি শুনতে আর আমি শুনতাম ওর কাছ থেকে ভ্রমণ কাহিনী। ওর বাবা ছিল
জাহাজের ক্যাপ্টেন, তাই ওর গল্পগুলো খুব জীবন্ত লাগতো।
একদিন এক বিপদ হল। গৌতম সেদিন কমন রুমে আমার সাথে
কথা বলেনি। টিফিনের সময় ক্লাস কক্ষেও দেখতে পেলাম না। অনেক খুঁজে শেষ পর্যন্ত দেখি
স্কুলের বাইরে বুড়ো বট গাছের নিচে একা বসে আনমনে খাবার খাচ্ছে। আমি কাছাকাছি আসতেই
দেখি পাশের পুরানো ইঁটের পাজা থেকে বেরিয়ে আসা মূর্ত্তিমান বিষধর ফনা তুলে এগিয়ে
আসছে ওর দিকে। আমি চীৎকার করে ওকে সাবধান করার চেষ্টা করলাম, ও শুনতে পেল না! আমি আর
থাকতে না পেরে তাড়াতাড়ি রাস্তায় পড়ে থাকা আধলা ইঁট তুলে ছুঁড়লাম সাপটার দিকে তাগ
করে। ইঁটের আঘাতে সাপের মাথাটা গেল থেঁত হয়ে। যতক্ষণ সাপটার নিঃশ্বাস চলছিল ঠিক ততক্ষণ
গৌতম চমকে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁপছিল। বেশ কিছুক্ষণ পর বন্ধুর প্রশ্বাস যখন স্বাভাবিক
হল, ততক্ষণে সাপটি প্রাণ হারিয়েছে আর গৌতমের জামা ঘামে একেবারে ভিজে জবজবে। তারপর
থেকে ও কোথাও গেলে আমাকে সঙ্গে যেতে হত। ওদের বাড়িতে যাতাযাত বাড়ল। ওর মা আমাকে ডাকতো
সোনাছেলে আর আমি ডাকতাম বড়মা। এভাবেই কেটে গেল আরো দু’টো বছর। এসে গেল উচ্চ-মাধ্যমিক
পরীক্ষা। পরীক্ষার শেষ দিনেই ঘটল আমার পিতৃ বিয়োগ। আমি দিশেহারা হয়ে পড়লাম। সেদিনও
বন্ধু গৌতম আর বড়মা’কে সবথেকে বেশি করে কাছে পেয়েছিলাম আমরা।
স্কুলের গণ্ডি পার হয়ে গৌতম গেল কলকাতায় আশুতোষ
কলেজে কেমিস্ট্রিতে অনার্স নিয়ে পড়তে আর আমি গ্রামের কলেজেই বি.কম-এ ভর্তি হলাম।
কাজেই বন্ধুর সাথে দেখা আর কথা বলা কিছুটা ভাটা পড়ল। আমাদের বাড়ি থেকে ওদের বাড়ির
দূরত্ব পায়ে হাঁটা তিরিশ মিনিটের পথ। মা আর আমি সময় পেলে ঘুরে আসতাম ওদের বাড়ি থেকে।
তাছাড়া মাঝেমধ্যে পথে-ঘাটে দেখা হলেই পুরানো দিনের কথা আর নতুন কলেজ জীবনের কথা পরস্পরের
মধ্যে সময়কে আপন করে নিত। এভাবেই কেটে গেল তিনটি বছর। এল ফাইন্যাল পরীক্ষা। এরই মধ্যে
হঠাৎ একদিন বাজারে ওকে দেখতে পেয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। ও বলল,
‘কিরে বন্ধু, আমাকে দেখতে পেয়ে কথা না বলে চলে যাচ্ছ যে, কি ব্যাপার!’ আমি বললাম,
‘আমার সময় নেই, আমাকে টিউশানি পড়াতে যেতে হবে…তাই!’ ও বলল, ‘সেকি আর পনের দিন পর
তোমার পরীক্ষা তুমি এখন টিউশানি করে নিজের পড়ার ক্ষতি করছো!’ আমি কোন কথা না বলে হন
হন করে চলে গেলাম পড়াতে। দু’দিন পর কলেজের জি.এস আমাদের বাড়ি এসে বলল, ‘তোকে প্রিন্সিপ্যাল
ডেকেছেন আগামীকাল।’ গেলাম কলেজ। প্রিন্সিপ্যাল আমার হাতে এডমিট কার্ড ধরিয়ে দিয়ে
বললেন – পরীক্ষাটা ভাল করে দিও।’ আমি অবাক হয়ে গেলাম, পরীক্ষার ফী জমা না দিয়েও প্রিন্সিপ্যাল
আমাকে পরীক্ষার এডমিট দিলেন!
পরে জেনেছিলাম বন্ধুই কলেজের জি.এস’কে দিয়ে সব ব্যবস্থা করিয়েছিল। যেদিন পরীক্ষার
ফল প্রকাশিত হল সেদিনও ঘরে ফিরে দেখি আমার বিধবা মা খরিদ্দারের পুরানো কাপড় সেলাই
করছে আর চোখের জল মুছছে। আমি মা’কে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘মা, আমি সেকেণ্ড ক্লাস পেয়েছি।
দেখ এবার আর আমাদের দুঃখ থাকবে না। আমি একটা কিছু করবোই। হঠাৎ পিছন থেকে দু’টি হাত
আমার চোখ চেপে ধরে বলল, ‘নাম বল, নইলে ছাড়বো না।’ সেই চেনা কণ্ঠস্বর। বললাম, ‘তুমি
সেই ব্যানার্জীর গৌতম, আমার প্রাণের বন্ধু।’ ফাস্ট ক্লাস পাওয়া বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে
সেদিন খুব কেঁদেছিলাম। আর দেখেছিলাম আমার মা’য়ের মুখের হাসি।
আর আজ। ষোলটা বছর কেটে গেছে। ও এখন কলেজের অধ্যাপক
আর আমি স্টেট ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ডের সিনিয়র কর্মচারী। কর্ম ব্যস্ততা বন্ধুত্বের অনেকটা
সময় কেড়ে নিলেও দেখা হলে গৌতম বলে ওঠে – ‘কি ব্যানার্জী কেমন আছো? কেমন আছেন আমার
বৌদি? তোমার ছেলে খুব দুষ্টু হয়েছেতো?’ আর উত্তরে আমি বলি, ‘তোমার মামনি কত বড় হল,
কোন ক্লাসে পড়ে এখন? এসো একদিন আমাদের নতুন বাড়িতে। আমার মা’য়ের স্বপ্ন আর বাবার
স্মৃতিতে গড়া নতুন বাড়িতে। সেখানে দেখা হবে আমাদের, আলাপ হবে আমাদের ছেলে মেয়েদের।
আর আমরা ফিরে যাব পুরানো দিনের নানা রঙের দিনগুলিতে।’
তারপর, আজ সেই দিন। সবাই মেতে উঠেছে বর্ষবরণ উৎসবে।
উৎসবকে কেন্দ্র করেই দু’টি পরিবার একত্রিত হয়েছি আমার মা’য়ের স্বপ্নে বোনা ‘মণীন্দ্র
ভবনে’। নব পরিচয়ে আগুন্তুকদ্বয়। খুশিতে ঝলমলে দু’টি পরিবারের সকল সদস্য। মা’য়ের
মুখে সোনালী হাসি। মনে মনে ভাবি, তোমার ‘সেতু’ আর আমার ‘বন্ধন’ হোক আমাদের সার্থক দিনের
উত্তরসূরী! রচিত হোক এক নতুন অধ্যায়!’
-----------------------------------------
Comments
Post a Comment