Skip to main content

মহ. আসফাক আলম

তোর নামটা

রায়গঞ্জ সারদা বিদ্যামন্দিরের মাঠে আতীব, তার বাবা সুজা ও মা রোমা সকাল সাড়ে দশটা থেকে অপেক্ষা করে বসে আছে। পরীক্ষার সময় দেওয়া হয়েছিল সকাল এগারোটা। চল্লিশ কিমি দূর থেকে আসতে হয় বলে সকাল সকাল বের হয়েছিল তারাসেরকমভাবে মুখে কিছু দেওয়া হয়নি। তাই বাস থেকে নেমেই শ্রীদুর্গা রেস্টুরেন্টে ঢোকে তারাগরম গরম লুচি ভাজা হচ্ছিল সেখানেতা খেয়ে সোজা চলে আসে স্কুলে সেই থেকে বসে আছে। এখন বেলা একটা বাজে। শুধু বসে আছে তা বলা যাবে না। আতীব তাদের শান্তিতে কি বসে থাকতে দেওয়ার পাত্র ? দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পুরো মাঠ। দোলনা, পিছলে পড়ার জিরাফ সিঁড়ি, ঘুরন্ত চেয়ার ইত্যাদি নিয়ে পুরো ব্যস্ত রয়েছে। ব্যস্ত করে রেখেছে তার বাবা মাকেতাতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সুজাকিন্তু তার চিন্তা কেবল আতীবকে নিয়ে – সে যদি ক্লান্ত হয়ে পড়ে! পরীক্ষকের সামনে যদি কিছু না বলতে পারে! তাহলে কী হবে? শেষের দিকে ডাক আসে আতীবের। তখন বেলা দু’টো। মাইকে হাঁক দেয়, আতীব, পিতা সুজা, শ্রেণি - উদয়। নয় নম্বর কক্ষে পরীক্ষা ও ইন্টারভিউ’য়ের জন্য ডাকা হচ্ছে।


আতীব তার বাবা মায়ের হাত ধরে ঢোকে পরীক্ষকের ঘরে। একটা বড় টেবিলের সামনে চারজন বসে আছেন। তার মধ্যে একজন গেরুয়া রঙের ধুতি-পাঞ্জাবি পড়া, কপালে তিলক দেওয়া ভদ্রলোক আছেন। টেবিলে সাজানো আছে মাটির তৈরি বিভিন্ন রঙের নানান ফল, সবজি। সামনাসামনি ছাত্রের বসার জন্য একটা ছোট্ট টুল আছে আর পাশাপাশি অভিভাবকেরদের বসার জন্য দু’টো চেয়ারআর তার পাশে, উত্তর কোণটিতে ছোট্ট টেবিলে, উল্টোদিকে মুখ করে কম্পিউটারের সামনে বসে রয়েছেন এক ভদ্রমহিলা। সম্ভবত সেখানকার শিক্ষিকা হবেন। বেশভূষা দেখে তাই মনে হয়। পরীক্ষকগণ আতীবের নাম, নামের স্পেলিং, সামনের একটি ফল দেখিয়ে সেটি কী ফল, তার রঙ কী, তার স্পেলিং ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করে পাঠিয়ে দেয় কম্পিউটার টেবিলের দিকেএবার তার বাবা মায়ের সম্পর্কে তথ্য জানতে চাই তারা। যা যা তাদের দরকার। তাদের একজন প্রশ্ন করেন,
আপনি কী করেন ?
আমি ব্লকের গ্রুপ সি কর্মচারী।
আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা কী ?
দর্শনে এম এ।
ও আচ্ছা। ম্যাডাম, আপনি কতটা লেখাপড়া করেছেন ?
বি এ অনার্স।
বাহ্‌, খুব ভালো। আচ্ছা, আপনারা একটা কথা বলুন তো, আপনাদের তো অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, মানে মাইনোরিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসেগুলিতে আতীবকে ভর্তি না করিয়ে এখানে ভর্তি করার কথা চিন্তা করছেন কেন ?
ধর্মীয় আচার-আচরণ, সেটা একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। সেটা ব্যক্তিগতই থাক। আমরা চায়, সে শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ হোক। শিল্প-সংস্কৃতি ছাড়া মানবতার শিক্ষা লাভ সম্ভব নয়।  
তারা একে-অপরের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে থাকে। শেষে একজন বলে ওঠেন,
এখানে আপনাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য ছুটি দেওয়া হয় না, সেটা জানেন ?
জানি।
তিলক, ধুতি পড়া ভদ্রলোক বলেন,
তবে এই শিক্ষাবর্ষ থেকে যেগুলো ন্যাশনাল হলিডে সেগুলোতে ছুটি দেওয়া হবে।
ইন্টারভিউ ও পরীক্ষা শেষ হয়। তারা কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে। আতীবের মা জিজ্ঞাসা করে,
আতীব বেটা, কম্পিউটার ম্যাডাম তোমাকে কী প্রশ্ন করছিলেন ?
আতীব বলে,
হাতি আর শেয়াল দেখিয়ে বলছিল, কার বুদ্ধি বেশি ?
তুমি কী বললে বেটা ?
বললাম, শেয়ালের। শেয়াল যে চালাক পণ্ডিত!
আর কী বললেন ?
লায়ন আর হরিণ দেখালোবলল এদের নাম কী, কে বেশি দৌড়াতে পারে ?
তুমি কী বললে ?
বললাম ডিয়ার বেশি দৌড়াতে পারে।
সুজা বুঝতে পারল, ছেলের দৌড় শুরু হয়ে গেছে। সিংহ তাড়া করতে শুরু করেছেএর ঠিক দশ দিনের মাথায়, ২৮ ডিসেম্বর রেজাল্ট টাঙানো হয়। আতীবের নাম আছে তাতে। দু’মাসের অগ্রিম মাইনে নিয়ে মোট বারো হাজার টাকা দিয়ে তাকে ভর্তি করায় তার বাবা।
ভর্তি করিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় কাউন্টারে জানতে চায়,
এদের ক্লাস শুরু হবে কবে থেকে ম্যাডাম ?
মার্চ মাসের কুড়ি তারিখদেখুন, প্রস্পেক্‌টাসে সব দেওয়া আছে। রুল’স ও রেগুলেশনগুলো  ভালো করে দেখে নেবেন।  
ও আচ্ছা। ঠিক আছে ম্যাডাম।
এর ঠিক পনেরো দিনের মাথায় সুজার প্রমোশন ও চাকরি ট্রান্সফার হয়ে যায় দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায়। তারা চলে যায় নতুন জায়গায়। আবার আতীবকে ভর্তি করানোর হ্যাপা। ইতিমধ্যে ভর্তির সময় পেরিয়ে গেছে। অনেক চেষ্টার পরে শেষমেষ ভর্তি করানো যায় এফ সি স্কুলে। আপার কে জি তে। সি বি এস ই বোর্ড, ইংলিশ মিডিয়াম। না, তার জন্য বেশি টাকা লাগেনি। অ্যাডমিশন, ড্রেস, বই-খাতা - সব মিলিয়ে চল্লিশ হাজার পাঁচশো।

আতীব এখন স্কুলে যায়। তার প্রথম স্কুল। কোনো কোনো দিন যায় বাবার সাথে, আর অধিকাংশ দিন মায়ের সাথে। প্রিয়াঙ্কা ম্যাডাম তাকে খুব ভালোবাসে। সেও খুব ভালোবাসে ম্যামকে। সব পড়া পারার জন্য ম্যাডাম তার গালে যেদিন চুমু দিয়েছিল সেদিন ছিল তার সবচেয়ে স্মরণীয় দিন। সেকি আনন্দ! সেই থেকে বাড়িতে সারাক্ষণ প্রিয়াঙ্কা ম্যাম, প্রিয়াঙ্কা ম্যাম করে যায়। প্রিয়াঙ্কা ম্যাম এই করে, প্রিয়াঙ্কা ম্যাম ঐ করে। আবার এক এক দিন এক এক বন্ধুর কথা বেশি বেশি বলে। আজ রূপসা বন্ধু হয়েছে, রিশাদের সাথে কাট্টি হয়েছে, অচ্চিস্মান আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, আক্সাদের সাথে টিফিন শেয়ার করেছি, শুভদেবের সাথে ভাব হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

একদিন সন্ধেবেলা। প্রতিদিনের মতো আতীব সেদিনও তার বাবার আঙুল ধরে লাফাতে লাফাতে মাঠে যায় বেড়াতে। খেলাধুলা করতে। হঠাৎ তার কী মনে হয়, বাবার আঙুল ঝাঁকানি দিয়ে বলে,
আব্বু, মুসলিম কী ?
চমকে ওঠে সুজা! থমকে যায় তার পা। ভারি ভারি ঠেকে যেন কে যেন তার পা পিছন দিকে টেনে ধরে ছেলের দিকে তাকায় সেমুখের কথাও কেমন হড়কে হড়কে যায় তার। ছেলে পুনরায় হাতে টান দিয়ে বলে,
বলো না, বলো ? মুসলিম কী ? আব্বু, বলো না, বলো ?
অ্যাঁ! হু !
বলো না, বলো ? মুসলিম মানে খারাপ নাকি ?
সুজা ভালোভাবেই বুঝতে পারছে, সে আর চুপ করে থাকতে পারবে না বেশিক্ষণ কিন্তু বলবেই বা কী ? অন্যদিকে আতীব সে তো ছাড়ার পাত্র নয়। আবার বলে,
বলো না, মুসলিম কী ? হিন্দু কী ?
সুজাকে এবার বলতেই হয়,
আরে, জানিস না। যারা নামাজ পড়ে তারা মুসলিম আর যারা পুজো করে তারা হিন্দু।
ব্যাপারটা লঘু ও সহজ করে দেখায় সে। কিন্তু মনে কি সেই সহজ ভাব আছে তার ? না, নেই। সেটা সে ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। সাতপাঁচ নানা জিনিস মনে ঘুরপাক খেতে থাকেআর তখনই আতীব বলে ওঠে,
আর যারা নামাজ পড়েনা, পুজো করে না তারা মুসলিম নয় হিন্দু নয় নাকি ? বলো ? তারা কী ? বলো ?
সুজা আরও গম্ভীর হয়ে যায়। অবাক হয়! ছেলের দিকে তাকায়। মুখে উচ্চারণ করে,
তারাও মানুষ বেটা।
সুজা উদ্বিগ্ন হয়তাড়াতাড়ি জানতে চায়,
তোমাকে কী কেউ স্কুলে কিছু বলেছে ? ম্যাডাম কিছু বলেছেন ?
না।
তাহলে তুমি এসব কথা বলছ কেন বেটা ? নিশ্চয় কেউ কিছু বলেছে ? বলোনা, কে কী বলেছে ?
কালকে অনিরুদ্ধ বলছিল, তোর নামটা মুসলিম মুসলিম লাগছে।
ইতিমধ্যে মাঠে পৌঁছে যায় তারা কিন্তু আজ তার কোনো কিছুতে মন লাগে না। চুপচাপ বসে থাকে। অন্যদিন মাঠের দেয়াল বরাবর দু’রাউন্ড পা চালায় সুজা। আজ বসেই থাকে আতীব কিছুক্ষণ বন্ধুদের সাথে দৌড়ঝাঁপ করে। না, তার আর ভালো লাগে না। এবার ওঠে পড়ে সে। আতীবের হাত ধরে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। কিন্তু তার কানে বাজতে থাকে সেই কথা –
‘তোর নামটা ...’
মাথা জোরে জোরে ঝাঁকানি দিতে থাকে সুজা এইভাবেই সে এক চিন্তার জায়গায় অন্য চিন্তাকে নিয়ে বসিয়ে এসেছে এতকাল। এবারও সে তার সেই পরিচিত পদ্ধতি ব্যবহার করে তাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে পুরাতন চিন্তাকে নতুন চিন্তা আনতে চায়। কিন্তু কী হল! যায় না যে আজ! বরং বারবার ফিরে ফিরে আসেআর সহস্র মুখ যেন তার কানের কাছে এসে একনাগাড়ে বলে চলে,
‘তোর নামটা ... ’, ‘তোর নামটা ...’ , তোর নামটা ...’

Comments

Popular posts from this blog

আলী হোসেনের ছোটগল্প। এক এক্কে এক।

এক এক্কে এক : ছোট্ট বেলা নামতা পড়ার সময় এভাবেই শুরু করত মান্তু। তখন জানতো না কি এর মানে, কেনই বা পড়তে হয়। মা বলতেন, নামতা হল অঙ্কের মাথা। কিম্বা মেরুদণ্ডও বলতে পারিস। এটা ঠিকঠাক না শিখলে অঙ্ক মেলে না। যখন প্রাথমিক স্কুল ছেড়ে মাধ্যমিকে পৌছেছে, তখন মায়ের কথার মানে বুঝেছে মান্তু। কিন্তু পরিণত বয়সে এসে, আজ বুঝেছে এর অন্য মানে। এটা না জানলে, জীবনের মানেটাই পালটে যায়। মিলতে চায় না জীবনের অঙ্কটাও। মান্তু তখন ক্লাস এইটে। হঠাৎই দুঃসংবাদটা এলো। ক্লাসে সেলাই দিদিমনি, ফ্রেঞ্চনটের গীট ধরে আটকানোর চেষ্টা করছেন। বোঝাচ্ছেন, কিভাবে একে কব্জা করতে হয়। মান্তু কিছুতেই এই গিঁটকে কব্জা করতে পারছেনা। মাথার ওপর বোঁবোঁ করে ঘুরছে পাখা, অথচ ঘামের স্রোতে ভাঁটার টান নেই মোটেও। বাইরের বাতাসে উত্তাপের পারদ নিশ্চয়ই লু-লেবেল ছাড়িয়েছে। বাতাসের শুষ্ক বুকে তরঙ্গ তুলে সে ছুটে চলেছে শরীর জুড়াতে আন্য কোথাও, অন্য কোনখানে। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে চাঁদনি থেকে দোকানের মাল নিয়ে ফিরছিল ফারহাদ। হঠাৎই চরকির মত ঘুরে গেল মাথাটা। পিচ-গলা রাস্তায় আছড়ে পড়লো মস্ত শরীর। পথ-চলতি নজর চকিতে ঘুরে এল ফারহাদের দিকে। কে বলে কলকাতার হৃদয়ে উষ্ণতার অভা...

মুর্শিদ এ এম - এর গল্প। ঠুনকো।

পুরো গল্প পড়তে গল্পকারের নাম -এর ওপর ক্লিক করুন ।। হোম পেজ-এ যেত এখানে ক্লিক করুন audio testing গল্পকারের কণ্ঠে গল্প পাঠ।  ঠুনকো একের পর এক প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে একেবারে দক্ষিণে, মনে হচ্ছিল একটু গেলেই সাগর এগিয়ে আসবে, একলা ত্যাজ্যপুত্রের মতো দাঁড়িয়ে থাকা এক্সপ্রেস ট্রেনটা দেখতে পেল ইয়াসিন। সাউথ ইন্ডিয়া যাবার প্রায় সব ট্রেন এই দিকের প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়ে। বন্যার কারণে কয়েকটি ট্রেন বাতিল হওয়ার পর কদিন হল খুলেছে। একাই এতটা পথ লটবহর টেনে গলদ্ঘর্ম হয়ে কামরায় ঢুকে নিঃশ্বাস ফেলল সে। এখনও এ সি চলেনি। চললে অসুবিধেই হত, হঠাৎ লেগে যেত ঠান্ডা। নিজের সিট খুঁজে মালপত্র রেখে চোখ-মুখ ধুয়ে, টুপিটা খুলে আবার পরে নিয়ে, ঘন সুবিন্যস্ত দাড়ি ভেজা হাতে মুছে খানিকটা জল খেয়ে স্বস্তি পেল যেন। একটা কালো ঢাউস ব্যাগকে কিছুতেই কব্জা করতে না-পেরে পায়ের কাছেই রেখে দিল ইয়াসিন।

নয়ারুণ ভট্টাচার্য্য

রেবন্তর স্ববধবিলাস ‘No one ever lacks a good reason for suicide’         - Cesare Pavese (1908-50) কাল এক দীর্ঘ, দীর্ঘ রাত্রিব্যাপী পরিক্রমায় গৃহত্যাগ করিব। পরিক্রমার অন্তে দেখিব তরঙ্গবিক্ষুব্ধ এক অপার জলধি। মৃত্যু কী এমনই দেখিতে? ভাবিলেও রোমাঞ্চকণ্টকিত