Skip to main content

আলী হোসেন

দ্বিতীয় পিতা

সকাল বেলা উঠেই চোখ দু’টো ডলতে থাকে মিরাজ। দুই হাতের মুষ্টি দুচোখের পল্লবের উপর রেখে কব্জির মোচড়ে ডলা যা্রে বলে। বিরামহীনভাবে। মুহূর্তেই অক্ষিগোলক দুটো লাল হয়ে ওঠে, যেন জবাফুল। সঙ্গে ফুঁপিয়ে কান্না। আজ সে কোন মতে মাঠে যাবে না। গরু চরাতে ওর মোটেও ভালো লাগে না। ওর ইচ্ছা, বড় হয়ে স্কুল মাস্টার হবে। সেজন্যে যে অনেক লেখাপড়া শিখতে হবে! অথচ মা, তাকে গরু নিয়ে মাঠে পাঠাচ্ছে। বুকের ভেতরটা ভারি হয়ে আসে। মনের কষ্টে দম বন্ধ হওয়ার মত অবস্থা। বুকের ভেতরের চাপটা বাড়তে থাকে ক্রমশঃ। বাড়তে বাড়তে এক সময় কষ্টের মেঘ আষাঢ়ে বৃষ্টির মত কান্না হয়ে ভেঙে পড়ে। খুব করে কাঁদতে পারলেই যে বুকটা আবার মেঘমুক্ত আকাশের মত হাল্কা হয়ে যায়, কিছু সময় গলা ছেড়ে কাঁদার পর মিরাজ তা বেশ অনুধাবন করে।
ছোড়ার শক দ্যাকো, মাস্টার হবে! বলি, তোর বাপ কোনো দিন ইস্কুলির মুক দেকেলো। গরু চরানো পাচুনটা ছেলের দিকে বাড়িয়ে ধরে আচিয়া, ‘যা, গরু গুলোন চইরে আন, কাজ দেবেনি। ছেলের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে, ‘কাঁচা ঘাস পেটে পড়লি গাইটার দুধ বাড়বে; এক কিলোর জাগায় দু’কিলো হবে, ইসকুলি গেলি কী বাড়বে শুনি’?
কথাগুলো এখনও কানে বাজে মিরাজের। সেদিন কোন মতে বোঝাতে পারে নি মাকে। তাই বাধ্য হয়েই মাঠে যায় মিরাজ। গরু চরাতে।
মাঠটা বেশ বড়। মাঠের চার ধার ঘিরে আছে সাত সাতটি সবুজ গ্রাম। গরু নিয়ে মাঠে নামলেই মিরাজের মন উদাস হয়ে যায়। মাঠ ঘেরা গ্রামগুলির দিকে চাইলে তার মনের আয়নায় ভেসে ওঠে রাখাল ছেলের সেই গাঁয়ের কথা, যেখানে ‘কলার পাতা দোলায় চামর শিশির ধোয়ায় পা
সেথায় আছে ছোট্ট কুটির সোনার পাতায় ছাওয়া
সাঁঝ আকাশে ছড়িয়ে পড়া আবির রঙে নাওয়া’
মিরাজের গ্রাম, মাঠের পশ্চিম দিকে। নাম চড়ুই গাছি। ঠিক উলটো দিকে আছে নাইগাছি। পাশেরটার নাম মেটেগাছি।
মিরাজের গ্রাম ছেড়ে পূবে নামলেই খোলা মাঠ। দু’ফসলা জমি। স্বাধীনতার পরপরই ডিপ টিউওয়েল বসতে শুরু করে। দেশ জুড়ে তখন সবুজ বিপ্লবের ডাক উঠেছে। ব্যাক্তিগত উদ্যোগে বসছে স্যালো মেশিন। তাই ডাঙা মাঠের সমস্ত অংশ জুড়ে শুরু হয়েছে বোরো ধানের চাষ। সোজাসুজি গরু নামানো তাই অসম্ভব।
গ্রামের উত্তর দিকে গোপালপুর। গোপালপুর ঘুরে নাইগাছি হয়ে মেটেগাছি দিয়ে মাঠে নামতে হয় মিরাজদের। মাঠে মানে বিলে। তিনগুন রাস্তা ঘুরে বিলে নামতে নামতেই বেলা যায় দুপুর হয়ে। সমস্ত বিল চোঁচড়া আর নাড়ার গোঁড়ায় গজানো ধানগাছে ভরা। পেটের টানে অভূক্ত গরু গুলো ওগুলোই খেতে থাকে গোগ্রাসে, মনের আনন্দে। তাই রখালি করার তেমন প্রয়োজন হয় না। সুতরাং হয় মাঠময় ‘থুড়ি-বাকারি’ খেলো, নয় তো কুনির মুখের কমে আসা জল সেঁচে কাদা ঘেটে মাছ ধরো।
কাদা ঘেটে মাছ ধরার যে কি আনন্দ, যে ধরেছে সেই জানে। বিশেষ করে পাঁকাল মাছ। কাদা কেটে পাঁকাল ধরার আনন্দই আলাদা। জল যত কমবে, পাঁকাল মাছ তত পাঁকের মধ্যে সেঁদিয়ে যাবে। জল সেচা শেষ হলে পাঁকের উপর চ্যাং, উলকো, শিঙি, মাগুর, নরম ঝোল কাদায় ভেসে উঠবে। কিন্তু পাঁকালের দেখা মিলবে না। বাঁহাতের পাঁচ আঙুলের ফাঁকে ডান হাতের পাঁচ আঙুন চালিয়ে কোদালের ফলার মত পাঁক-কাদা কাটো, পাঁকালগুলো বেরিয়ে আসবে। মজার ব্যাপার, পাঁক কাদার ভেতরে থাকলেও এই মাছের গায়ে কিন্তু কাদা লাগে না। পাঁকাল নাম বোধ হয় একারণেই।
এই পাঁকাল ধরার মজাই একদিন মিরাজকে বিল-প্রেমিক করে তুলেছিল। তাই স্কুলের সাথে সাথে রাখালি করতে সে বিশেষ আপত্তি করেনি। বাবা ঠিক করে দিলেন, তিন দিন মিরাজ আর তিন দিন ওর বোন গরু নিয়ে মাঠে যাবে; পালা করে। বাকি দিনগুলো স্কুলে।
কিন্তু এখন কি আর তিন দিন স্কুলে গেলে চলে? মিরাজ এখন ক্লাস নাইনে। আর দু’বছরের মাথায় মাধ্যমিক দেবে। পড়ার চাপ তাই অনেক। ঠিক করেছে, মাকে সোজাসুজি বলে দেবে, হয় মাঠ, নয় স্কুল। দু’নৌকায় পা দিয়ে সে চলতে পারবে না।
কেন, কোন জমিদারের ব্যাটা রে তুই, যে ইসকুলি গেলি মাঠে যাবিনে?
মিরাজ মাথা নিচু করে।
মা গলা চড়িয়ে বলতে থাকে, তোর বাপের কি দশ বিগে জমি আচে? যাদের আচে, তারা যেদি মাঠে যাতি পারে, তুই পারবি নে কেন? এক বস্তা ঘাস কেটে রেখে গেলি কি তোর গতর ক্ষয়ে যাবে! ভোলাকে দেখিয়ে বলে, ওর বাপের মাঠ ভর্তি জমি; ও যদি মাঠ আর ইসকুল দু’ই করতি পারে, তুই পারবিনে কেন?
একের পর এক প্রশ্নের দাপটে খেই হারিয়ে ফেলে মিরাজ। কোন উত্তর খুজে পায় না। তাই বাধ্য হয়েই মাঠে পা বাড়ায়। কিন্তু মনটা? মনটা পড়ে থাকে স্কুলে। আজ মোহিতের সঙ্গে গাইঘাটায় যাওয়ার কথা ছিল ওর। আশিসদার সঙ্গে দেখা করবে।
আশিসদা মানে আশিস কর্মকার। পেশায় টিউটর, লোকে বলে ‘প্রাইভেট মাস্টার’। নেশায় রাজনীতিক। ছোট-খাটো পাড়ার-নেতা। এতেই জীবন উৎসর্গ করে বসে আছেন।
মোহিত ওরই ছাত্র। মিরাজকেও নিয়ে যাবে ওর কাছে। দারুন ইংরাজি আর বাংলা পড়ান নাকি! বাংলা ব্যাকরণে আশিসদা’র জুড়ি মেলা ভার। মহিত মন্তব্য করে। মিরাজ ব্যাকরণে দুর্বল। তাই ওর কাছেই পড়ার পরামর্শ দেয় মোহিত।
কিন্তু টাকা?
টিউশনি করবি। মোহিত উপায় বার করে।
মিরাজ না বললেও মোহিত বুঝতে পারে, মিরাজের বাবা গরিব। তালি দেওয়া প্যান্ট আর না-কাচা একটাই জামা, রোজ রোজ পরে  আসাটা তার বড়ো প্রমাণ।
উপায়টা মনে ধরে মিরাজের। বলে, তাহলে টিউশনিটা ধরি। তারপর যাবোখন।

মিরাজ টিউশনি ধরেছে। সেদিন যাওয়া হয় নি। তবে আজ যাবেই। সেভাবেই তৈরী হয়েছে মিরাজ। স্কুলে এসে দেখে মোহিত নেই। মনটা খারাপ হয়ে যায়। আজকাল তার ভাবনার সঙ্গে কিছুই যেন মিলছে না। বেশীর ভাগ সময়ই এমন ঘটছে। ভাবছে এক, হচ্ছে আর এক। শালা কপালটাই খারাপ, মনে মনে বিরক্ত হয় মিরাজ। মোহিতকে তো কখনও ফালতু ছেলে মনে হয় নি। তবে এলো না কেন? একমাত্র ওই তো মন খুলে কথা বলে মিরাজের সাথে। বাকিরা ‘নেড়ে’ বলে খেপায়। কেন বলে, কি তার মানে, কিছুই জানে না মিরাজ। সারা স্কুলে ও-ই একমাত্র মুসলিম। আর নেড়ে শুধু ওকেই বলা হয়। এটুকু ছাড়া আর কিছুই মাথায় ঢোকে না। একমাত্র ব্যতিক্রম মোহিত। খুব আপন করে নিয়েছে।  কেন নিয়েছে এ পশ্ন মনে এলেও প্রকাশ করেনি কখনও। কোথায় যেন একটা ভয় তাড়া করে বেড়ায়। ও-ও যদি পালটে যায়! বেফাস কোন কথায় যদি বিগড়ে যায় ওর মন! সমির কিম্বা বাবলুদের মত আচরন করে। তাই সাহস করে না। সাত-পাঁচ  ভাবতে ভাবতে স্কুল থেকে বেরিয়ে পড়ে। ছুটির ঘন্টার সাথে সাথে। রাস্তায় উঠতেই দেখে মোহিত দাঁড়িয়ে। মুহূর্তে জল্পনার শেষ। মনটা যেন ফুর ফুর করে উড়তে থাকে, দখিনা বাতাসে।
চল, মোহিত সংক্ষেপে বলে।
মিরাজ এই টুকু বলার অপেক্ষায় ছিল। বলল, ইস্কুলে এলিনা যে।
উপায় ছিল না।
এখন এলি?
তোর জন্যে।
আর কথা না বাড়িয়ে দু’জনেই উঠে পড়ে বাসে। বাস ভাড়া দশ-দশ কুড়ি পয়সা। মোহিত দিয়ে দেয়। মিরাজ কিছু বলে না। কি-ই বা বলবে! দেওয়াড় মত পয়সাও তো ওর নেই।
বাস থেকে নামতেই মোহিত চিৎকার শুরু করে, আশিস দা...।
এই প্রথম আশিসদাকে দেখলো মিরাজ। গায়ের রং কালো, বয়সের তুলনায় শরীরটা ভারী। মাথায় পাতলা চুল। কপালটা বেশ চওড়া। গলায় ছিট ছিট ছোলির দাগ। আর, মুখে গালভরা হাসি।
ক্লাবে চল; আসছি।
একটা জরুরী কথা আছে। একটু দাঁড়াবেন ?
বল।
মিরাজকে দেখিয়ে বলে, ও আপনার কাছে পড়তে চায়।
বেশ তো, ঐক্যতান ক্লাবে চলে এসো। সকাল ছটা থেকে সাড়ে আট-টা। মাসিক পঁচিশ টাকা মাত্র।

মিরাজ টিউশন পেয়েছে কুড়ি টাকার। বাকি পাঁচ টাকার কি হবে? তাছাড়া সকাল সাতটার আগে বাস নেই। কিভাবে যাবে ও ছ’টার মধ্যে? একটা উপায় অবশ্য আছে। বাবা যদি রাজি হয়!
সপ্তাহে দুদিন আমি দে আসতি পারি। শনিবারটা পারবো না। ওই দিন তো ডিমের ভাড়া থাকে। ছটার মধ্যে গোবরডাঙায় পৌচাতি হয়। সন্তোষ মাষ্টারের পল্ট্রির ডিম। বাঁদি ভাড়া। কোন মতেই হাতছাড়া করা যাবে না যে বাপ।
ঠিক আছে। দুদিন গেলেই হবে। আর একদিন হেঁটেই চলে যাব। মিরাজ বাবাকে বলে, আমাকে পাঁচটায় ডেকে দিলেই হবে।
তুই পারবি তো বাপ! হেঁটে যাতি কষ্ট হবে না?
ঠিক পারবো, তুমি দেখে নিও। তুমিই তো বল, কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না। মিরাজ উত্তর দেয়। তবে একটা শর্ত আছে। রাখবে তো?
রাখবো রে বাপ রাখবো। তোর দিয়েই তো মোর স্বপ্ন পূরণ হবে। জানিস আব্বা, সবে পাকিস্তান হয়েচে। যশোরে মামার বাড়ি গিচি। পুলিশে নোক নেচ্চে শুনে নাইন দেলাম। চেহারা আর পোশাক দেখে ভেবেচে অনেক নেকাপড়া জানে। সোজা যশোর থানার ও সি করে দেলো! ভেবিলাম, বড়জোর কনস্টেবল-ঠেবল করে দেবে, ও ম্যানিজ করে নোবানি। ভাব গতিক দেকে একদিন রাতের বেলা পেলগে বাঁচি। জানিস, সেদিন নেকাপড়া জানলি, আজ আমার ভাত খায় কে!  বলতে বলতে গলা ধরে আসে কালু মিঞার। তুই যেদিন হলি, সেদিন পতিজ্ঞা করেলাম, যেত কষ্টই হোক, তোকে নেকাপড়া শেকাবুই। তাই পাততি আমাকে হবেই। নিদিনপক্ষে মাদ্যমিকটা তো দিতিই হবে।
বাবার কথা শুনে বুকে বল পায় মিরাজ, মনের কোণে আশার আলো জেগে ওঠে। আমি ভ্যানে বসে যেতে পারবো না। আমি চালাবো, তুমি বসে যাবে। এটাই আমার শর্ত।
যা! তাই কি হয়?
তুমি চালিয়ে গেলে আমার লজ্জা করবে।
কেন?
শোন নি অন্ধ বাউলটার গান। হাটবারের দিন ভাস্কর লবন বেচে আর গায়,
‘ছেলে যায় সাইকেলেতে বাপকে বলে হেঁটে চল,
হায়রে কোলিকাল’।
ও আমি পারবো না। লোকে খারাপ বলবে।
আজও মিরাজের চালিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে গেছে কালুর। তাই সকালে ওঠা যায় নি। মিরাজ চালালে সময় মত পৌছানো যাবে না। তাই মিরাজের বাপই চালাচ্ছে।
এখানে থামো আব্বা।
কেন?
এইটুকু আমি হেঁটে যাব।
কেন? কালু মিঞা আবার প্রশ্ন করে।
মিরাজ উত্তর না দিয়ে লাফ মেরে ভ্যান থেকে নেমে পড়ে। কেমন যেন অস্বস্থি হচ্ছিল মনের মধ্যে। আশিসদা যদি দেখে ফেলে। যদি প্রশ্ন করে, অত বড়ো দামড়া ছেলে বাপের ভ্যানে বসে এলি! অথবা অত পয়সা......
ক্লাবে ঢুকতেই আশিসদা বলে, এত পথ তুমি ভ্যানে এলে!
যা ভয় পেয়েছিল তাই হল!
এত পয়সা খরচ করার দরকার কি? বাসে এলেই তো হয়।
কি বলবে মিরাজ! দু’মাস হতে গেল এখনও মাসের ফি দেওয়া হয়নি। অথচ বাসে দশ পয়সার বদলে ভ্যানে আসছে তিনগুন পয়সা দিয়ে। ব্যাপারটা বড়ো লজ্জার হয়ে যাচ্ছে। আবার সত্য কথাটাও বলতে পারছে না। মাথা নিচু করে মিরাজ। সমস্ত শরীর জুড়ে অস্বস্থির কাপন ওঠে। মনে মনে বলে, কি কপাল করে যে জন্মে ছিলাম! চোখের কোন ভিজে আসে মিরাজের। মোহিত ব্যাপারটা জানে। ইসারায় বলে, আশিসদা, উনি ওর বাবা।
আশিস অবাক হয়। একবার মিরাজের, একবার মোহিতের মুখের দিকে তাকায়। তারপর মিরাজকে লক্ষ্য করে বলে, সত্যি!
মিরাজ আবার মাথা নিচু করে।
মিরাজের মৌনতায় আশিস আরও একবার আবাক হয়।

মিরাজ আজ স্কুল টিচার। থাকে যোগেশগঞ্জ বাজারে। বাড়ি ভাড়া করে। বাবা-মাও সঙ্গে থাকে। ওখানকার উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে বাংলার টিচার। হিংয়লগঞ্জ থেকে সাড়ে ছ’ঘন্টার নদী পথ, ভটভটিতে। তাই ইচ্ছা করলেই বাড়িতে আসা হয় না। কিন্তু আজ তাকে ফিরতেই হবে। আশিসদার খুব শরীর খারাপ। মাঝে মাঝেই বুকের মাঝখানটায় ব্যাথা হয়। কখনও কখনও ব্যাথা ডান হাত, বাঁ হাত, গলা ও চোয়ালে ছড়িয়ে যায়। মনে হয় কেউ যেন বুকে পাথর চাপিয়ে দিয়েছে। বুকটা ভার ভার লাগে। আন্টাসিট খায় গ্যাসের ব্যাথা ভেবে। কিন্তু এখন আন্টাসিট খেলেও কাজ হচ্ছে না। ডাক্তার বলেছে আনস্টেবল আঞ্জাইনা। বুকের ব্যাথাটা পনের মিনিট থেকে দেড় ঘন্টা পর্যন্ত স্থায়ী হচ্ছে। যদি কিছু হয়ে যায়! মুখ দেখাতে পারবে না মিরাজ। অসুস্থ মানুষটাকে একবারের জন্য দেখতে যাওয়ার সময় হয় নি! ভূটভূটির বিকট আওয়াজ ভেদ করে কানে বাজছে সেই সব পুরানো দিনের কথা।
সবে দু’মাস হল টিউশনি ধরেছে। হাতে পেয়েছে এক মাসের টাকা। কুড়ি টাকা। সেটাই দেবে আশিসদাকে। কিন্তু কি করে বলবে। শেষমেশ মোহিতই দায়িত্ব নেয়।
আশিসদা, মিরাজ দু’মাসের টাকা একবারে দিতে পারছে না। ও টিউশনির পুরো টাকাটা হাতে পেলেই আপনাকে দিয়ে দেবে। মিরাজ সাহস করে হাত বাড়ায়।
না না, টাকা দেওয়ার দরকার নেই। তাছাড়া......
মিরাজ বাধা দিয়ে বলে, সত্যি বলছি দাদা, পুরো টাকাটা হাতে পেলেই আপনাকে দিয়ে দেব। প্লীজ রাগ করবেন না।
রাগ! কেন?
মিরাজ ইতস্তত করে, তারপর বলার চেষ্টা করে, পুরো টাকাটা দিতে পারছি না বলে।
এবার কিন্তু সত্যিই রাগ করবো।
কিন্তু মিরাজ নাছোড়।  বাধ্য হয়েই টাকাটা হাতে নেয় আশিস। তারপর মিরাজের হাত ধরে। বাঁ-হাতে মিরাজের ডান হাত। চল টিফিন করে আসি।
কিন্তু...
কোন কিন্তু নেই। আজ থেকে তুই আমার ছোট ভাই।  এই টাকাটা ধর, খাতা পেন্সিল কিনে নিবি। আর যখন যা দরকার আমাকে বলবি। টাকা তো কম রোজগার করি না, কাজে লাগাতে পারি কই?
মিরাজ অবাক হয়। কি শুনছে ও! যা শুনছে তা সত্যি তো! নিজের নিঃসন্তান কাকা যে কথাটা বলতে পারেনি, তাই বলছে আশিসদা, একজন ভিন জাতের মানুষ! এ স্বপ্ন না তো? আশিসদার গলায় যেন লালনের সুর.........
জাত গেল জাত গেল বলে
একি আজব কারখানা
...........................
আসবার কালে কি জাত ছিলে
এসে তুমি কি জাত নিলে
কি জাত হবা যাবার কালে
সে কথা ভেবে বল না...।

সত্যিই তো। আশিস দা কেন ভাবলো না? জাতের কথা! নিজের জাতের মানুষ গুলো কেন তার পাশে এসে দাঁড়ায় না। তাহলে কি জাতের চেয়ে পয়সা বড়। তা যদি হয়, আশিসদা কেন...... ? মিরাজ গুলিয়ে ফেলে।
হয়তো বা আশিষদার জাতটাই আলাদা। পয়সা দিয়ে তাকে কেনা যায় না। তাই অনায়াসেই হাত বাড়াতে পারে মিরাজের মত ভিন-জাতের ছেলের দিকে। সত্যি কথা বলতে কি সেই থেকে আশিসদাই তার অবিভাবক, সেই তার বাপ। জীবনের প্রথম ফুলপ্যান্ট, আশিসদার দেওয়া। প্রথম জাঙ্গিয়া আশিসদাই দিয়েছেন।  কৈশোর থেকে যৌবনের প্রথম পর্বে, যা কিছু প্রথম কিম্বা শেষ তার সব কিছুর সঙ্গে আশিসদার আশিস এবং তার প্রত্যক্ষ কিম্বা পরোক্ষ ছোঁয়া রয়েছে।
মাধ্যমিকের প্রথম দিন। মিরাজ ভাবতেই পারে নি যে তার জন্য কেউ অপেক্ষা করতে পারে। পরীক্ষার প্রথমার্ধ শেষ। টিফিনের সময় শুরু হয়েছে। সবাই টিফিন নিয়ে ব্যাস্ত। আধ ঘন্টার টিফিনে হুড়োহুড়ি অবস্থা। এইটুকু সময়ের মধ্যে টিফিন সারতে হবে, আবার দ্বিতীয় পত্রে চোখ বোলাতে হবে। বাইরে বাবা কিম্বা মায়েরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। চোখে-মুখে উৎকন্ঠা। যেন বাবা-মায়েরাই পরীক্ষায় বসেছে। গেটের বাইরে থেকে ছেলে মেয়েদের কাছে টিফিন পৌছে দেওয়ার জন্য ছোটাছূটির যেন শেষ নেই।
কিন্তু মিরাজের কোন তাড়া নেই। দুপুরে টিফিন খাওয়ার কোন রেওয়াজই তো নেই ওদের। আর টিফিন নিয়ে আসবে, বাবার এমন সময় বা সামর্থ, দু’টোর কোনটাই নেই। রাত্রের জন্য দানাপানির জোগাড় করতেই তার দিন কেটে যায়। নিশ্চিন্তে দ্বিতীয় পত্রে চোখ রাখে মিরাজ।
তোর নাম মিরাজ?
মিরাজ মাথা তোলে। চোখের ইশারায় বলে, হ্যাঁ।
তোকে টিফিন খেতে ডাকছে।
মিরাজ চোখ নামায় বইয়ের পাতায়। ভাবে, আসার মত তো কেউ নেই। বোধহয় ভুল ভেবেছে।
ছেলেটি  পিছনের বেঞ্চ থেকে মিরাজের কাঁধে হাত রাখে, গেটের কাছে তোর দাদা দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি যা, এখনি ঘণ্টা পড়ে যাবে তো!
মিরাজ ভাবে, তা হলে কি আব্বাই এলো? গুটীগুটি পায় এগোয়। গেটের কাছে যেতেই কানে আসে আশিসদার গলা। মিরাজ, আমি এখানে। টিফিনটা নিয়ে যা।
একটা ডাব, একশো গ্রাম সন্দেশ, একটা পাউরুটি। দুহাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন আশিসদা। মিরাজ ভাবে, এ জায়গায় আব্বা কিম্বা বাবু মানে চাচাকেই মানায়, খালি হাতে হলেও, বুকটা আমার  ভরে যেত। মিরাজের পায়ের গতি মন্থর হয়ে যায়, গলার স্বর যায় জমে । বলতে গেল, এ আবার কেন? দুপুর বেলা তো আমার টিফিন লাগে না দাদা। কিন্তু গলা থেকে কিছুই বের হল না। যেন গায়েবি আওয়াজ এল, টিফিনটা নে মিরাজ, টিফিনটা নে। ইনিও তোর আব্বার মত, তোর দ্বিতীয় পিতা।

বাবু, সবাই তো নেমি গেল। আপনে নামবেন না?
নৌকা ঘাটে লেগেছে কখন, কখন ভটভটির আওয়াজ বন্ধ হয়েছে, মিরাজ খেয়াল করে নি।
বাবু, আপনের ফোনটা বাজতিছে যে!
মাঝির ডাকে মিরাজের ভাবনায় যতি পড়ে। তড়িঘড়ি ফোনটা কানে ধরে। মাঝি অবাক হয়ে লক্ষ্য করে, হ্যলো বলার পর বাবুটি কেমন থোম মেরে গেছে। কোন কথাই বলছে না, কান থেকে ফোনটা নামায়ও না, নিজেও নামে না নৌকো থেকে। কেবল চোখদুটো ক্রমশঃ ভিজে উঠছে। মাঝি জিজ্ঞাসা করে, বাবু, কোন খারাপ খবর?
মিরাজ নদীর জলের উপর তাকিয়ে থাকে স্থির চোখে। জলের কাঁপনকে প্রাণপণ ঠেকানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুতেই যেন পারছে না। কম্পনের মধ্যে ক্রমশঃ তলিয়ে যাচ্ছে তার স্বপ্নের মুখ, তার দ্বিতীয় পিতা।

Comments

Popular posts from this blog

আলী হোসেনের ছোটগল্প। এক এক্কে এক।

এক এক্কে এক : ছোট্ট বেলা নামতা পড়ার সময় এভাবেই শুরু করত মান্তু। তখন জানতো না কি এর মানে, কেনই বা পড়তে হয়। মা বলতেন, নামতা হল অঙ্কের মাথা। কিম্বা মেরুদণ্ডও বলতে পারিস। এটা ঠিকঠাক না শিখলে অঙ্ক মেলে না। যখন প্রাথমিক স্কুল ছেড়ে মাধ্যমিকে পৌছেছে, তখন মায়ের কথার মানে বুঝেছে মান্তু। কিন্তু পরিণত বয়সে এসে, আজ বুঝেছে এর অন্য মানে। এটা না জানলে, জীবনের মানেটাই পালটে যায়। মিলতে চায় না জীবনের অঙ্কটাও। মান্তু তখন ক্লাস এইটে। হঠাৎই দুঃসংবাদটা এলো। ক্লাসে সেলাই দিদিমনি, ফ্রেঞ্চনটের গীট ধরে আটকানোর চেষ্টা করছেন। বোঝাচ্ছেন, কিভাবে একে কব্জা করতে হয়। মান্তু কিছুতেই এই গিঁটকে কব্জা করতে পারছেনা। মাথার ওপর বোঁবোঁ করে ঘুরছে পাখা, অথচ ঘামের স্রোতে ভাঁটার টান নেই মোটেও। বাইরের বাতাসে উত্তাপের পারদ নিশ্চয়ই লু-লেবেল ছাড়িয়েছে। বাতাসের শুষ্ক বুকে তরঙ্গ তুলে সে ছুটে চলেছে শরীর জুড়াতে আন্য কোথাও, অন্য কোনখানে। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে চাঁদনি থেকে দোকানের মাল নিয়ে ফিরছিল ফারহাদ। হঠাৎই চরকির মত ঘুরে গেল মাথাটা। পিচ-গলা রাস্তায় আছড়ে পড়লো মস্ত শরীর। পথ-চলতি নজর চকিতে ঘুরে এল ফারহাদের দিকে। কে বলে কলকাতার হৃদয়ে উষ্ণতার অভা

শুভ্রা সাহার ছোটগল্প। লকডাউন।

গল্পকারের কন্ঠে গল্প পাঠ। গল্পের নাম : লক ডাউনের গল্প গল্পকারের কন্ঠে গল্প পাঠ। গল্পের নাম : লক ডাউন গল্পকারের কন্ঠে গল্প পাঠ। গল্পের নাম : লক ডাউনের গল্প আলোচিতা এখন আর আগের মতো বোর হয় না। ঘরে বসেই ছোট বোন সঞ্চিতাকে নিয়ে অনলাইনে গান, বন্ধুদের সঙ্গে গল্প, বিভিন্ন প্রোগ্রাম করে সময় কাটিয়ে দেয়। লকডাউন-এ পড়ে কি যে নাজেহাল অবস্থা সকলের! মাত্র কয়েকদিন আগে, দিল্লি থেকে বাড়ি ফিরেছে সে। তখন তো ওর আসার কথাই ছিল না। হঠাৎ বাবার হার্ট অ্যাটাক হওয়াতেই আসতে হলো। আলোচিতা অর্থাৎ আলো। আর সঞ্চয়িতা অর্থাৎ সঞ্চিতা। ওরা দু'বোন। বাবা বিরাজবাবু স্কুলের শিক্ষক। মা রূপালি দেবী গৃহিণী। আলো দিল্লিতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেছে গতবছর। সঞ্চিতা দ্বাদশ শ্রেণীতে। শিক্ষকতা করার সুবাদে আলোর বাবা বিরাজ বাবুর এলাকায় যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। ওদের এলাকায় হিন্দু মুসলিমের সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি। বিরাজ বাবুর অনেক মুসলিম ছাত্রও আছে, যারা প্রায়ই ওনার কাছে আসে। বিভিন্ন মতামতের জন্য। বিরাজবাবু বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন। সুনাম

সুদীপ্ত ভাস্কর দত্তের ছোটগল্প। ২০২১ : করোনার পরে।

audio testing গল্পকারের কণ্ঠে গল্প পাঠ  ২০২১ : করোনার পরে নদীর জলটা এত টলটলে, পরিষ্কার আগে দেখিনি কোনদিন! পাড়ে বসে একটা মুগ্ধতা নিয়ে স্বগতোক্তি করল অরুণ। বসন্তের আরম্ভে এই মৃদুমন্দ বাতাসটা প্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছিল।। পড়ন্ত বিকেলে নির্জন নদীর তীরে, গাছের পাতার আড়াল থেকে একটা বউ কথা কও মাঝে মাঝে ডেকে উঠছিল। করোনা মহামারী রোধের চেষ্টায় সারা পৃথিবী জুড়ে যে লক ডাউন চলেছিল, তার ফলেই প্রকৃতি এখন দূষণমুক্ত, নির্মল।