Skip to main content

দেবাশিস দেব

ইচ্ছে
দেবাশিস দেব
      দুপুরবেলা বারান্দায় বসে ঝিমোচ্ছিল হরিদাসী। ঠা ঠা রোদ বাইরে, ঘরের ভেতরটাও তাতিয়ে আছে। বারান্দায়  মাঝেমাঝে একটু হাওয়া দিচ্ছিল, উঠোনের জবাগাছটার পাতা নড়ছিল ইতিউতি। দেয়ালে হেলান দিয়ে হরিদাসী মাথামুণ্ডু সব ভাবছিল। গোপাল কাল সকালে আড়তে গিয়েছে মাল আনতে, বিকেলে ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু ফেরেনি, হয়ত কোন কাজে আটকে গেছে। মাঝেমাঝে এমন যে হয়না তা নয়, কিন্তু হরিদাসী চিন্তা এড়াতে পারেনা। মায়ের মন, সর্বক্ষণ খারাপ চিন্তাই আগে আসে। কখন ফিরবে কে জানে? বাসের সময় জানা নেই হরিদাসীর। অবশ্য দরকারও পড়েনা বিশেষ। এই গ্রামেই জীবনটা প্রায় কেটে গেল। ষাট বছর হতে চলেছে বয়স। হরিদাসী ভাবে, কবে বউ হয়ে এসেছিল এই বাড়িতে, গোবিন্দর হাত ধরেসেও অনেকদিন , বছর চল্লিশেক তো কম করে। গোবিন্দ গান  গাইত, কীর্তন , পালা এইসব। ঘোষেদের বাড়িতে বছরে দুবার বাঁধা ছিল। এছাড়াও আশেপাশের গ্রামগঞ্জ থেকে ডাক আসত। মুদির দোকানটা নামমাত্র , ব্যবসায় কোন দিনই সেরকম মন ছিল না গোবিন্দর। সন্ধে হলেই পুরনো হারমনিয়ামটা নিয়ে বসে যেত। রাধার মানভঞ্জন , আরও কতকি? হরিদাসী মুখ্যু মেয়েমানুষ, লেখাপড়া শেখেনি একেবারেইপালাকীর্তনের রস বিশেষ বুঝত না, কিন্তু বসে বসে শুনত। শুনত না গোবিন্দকে দেখত, বলা শক্ত। ঝাঁকড়া চুল, লম্বা নাক, কালোর মধ্যে চেহারাটা খারাপ ছিল না গোবিন্দর। চোখ বুজে, মগ্ন হয়ে গোবিন্দ গাইছে, লোকেরা বাহবা দিচ্ছেএতেই মোহিত হয়ে যেত হরিদাসী। ওই শক্ত সবল লোকটা হঠাৎই মরে গেল। ডাক্তার বদ্যি বিশেষ কিছু করার সময় পাওয়া যায়নি। গোপাল তখন ছোট, সবে হামাগুড়ি দেওয়া শিখেছে। এ বাড়ি ও বাড়ি কাজ করে, আঁতুড় ঘর তুলে দিয়ে কোন মতে ভাতের যোগাড় করেছে হরিদাসী। গোপাল বড় লক্ষ্মীছেলে ছিল বরাবর, জ্বালাত না একদম। দশক্লাস অব্দি পড়াশোনাও করেছে। তারপর হরিদাসী আর চালাতে পারেনি। ওটাই হরিদাসীর একমাত্র দুঃখ। বাবার বন্ধ মুদির দোকানটা আবার নতুন করে শুরু করেছে , হরিদাসীর কিছু ধারদেনাও শোধ করে দিয়েছে গোপাল। ঘরের থেকে একটুকরো সুপারি এনে চিবোতে বসল হরিদাসী। ছেলেটা কখন আসে?
      সন্ধের সময় গোপাল এল। তবে একা না। সঙ্গে একটি মেয়ে। বয়স কুড়ি বাইশ হবে। সোমত্ত মেয়ে, গায়ের রংটা একটু ময়লা কিন্তু চটক আছে চেহারায়। উঠোনে দাঁড়িয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকাচ্ছিল হরিদাসীর দিকে। হরিদাসী  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলনা , গোপাল বিয়ে করেছে না জানিয়ে। হায় কপাল এবার কি হবে? কোন জাতের মেয়ে কে জানে? সারাগ্রামে জানাজানি হবে। হরিদাসী প্রাণ থাকতে এ হতে দেবেনা। ঝাঁটা মেরে তাড়াবে মাগীটাকে। তার আগেই গোপাল বলল, “তুমি যা ভাবছ তা নয়।”
---“ তাহলে কে এটা?” হরিদাসী কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে উঠল।
---“ বলছি সব, আগে জল দাও এক গেলাস।” হরিদাসী জল আনতে ভেতরে গেল।
গোপাল কিভাবে শুরু করবে খেই পাচ্ছিল না। কুসুম উঠোনের এক কোনায় জবাগাছটার সামনে দাঁড়িয়ে একমনে পাতা ছিঁড়ছে।
---“ ওর নাম কুসুম। জন্ম থেকেই বোবা। ” গোপাল শুরু করলহরিদাসী চোখ ছোটছোট করে শুনছে।
---“চরনদাসের বাড়িতে কাজ করত। চরনদাসকে চেন তো? ” গোপাল জিজ্ঞেস করল।
---“ না চিনিনা। কে সে?”
---“ আড়তদার, যার থেকে আমি মাল আনি”
--“ অ” হরিদাসী এবার বুঝল।
--“ চরণ দাসের বাড়ীতে ছোট থেকে কাজ করত। চরণের বউ ওকে এখন আর রাখতে চায়না। আর বেশিদিন রাখলে বিয়ে দিতে হবে। চরণ বলল, তুই যদি চাস তাহলে নিয়ে যেতে পারিস, তোর মায়ের সাহায্য হবেকাজেকম্মে খুব ভাল। তাই নিয়ে এলাম। এবার তুমি যদি রাখতে চাও তাহলে রাখ, নাহলে ফিরিয়ে দিয়ে আসব। ওকে অনাথ আশ্রমে দিয়ে দেবে। চৌদ্দপুরুষে কেউ নেই ওর, আর থাকলেও বোবা কি আর বলতে পারে?” হরিদাসী মহাসংকটে পড়ল। বয়স হয়েছে অনেক, হাঁটুর ব্যথাও বেড়েছে আজকাল, তবু সংসারের সব কাজই করতে হয়। গোপাল সেই সকালেই দোকানে চলে যায়, কোন কোন দিন দুপুরে খেতে আসে। বেশির ভাগ দিনই বাজারেই খেয়ে নেয়, রাতে বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় নয়টা। কথা বলার লোক নেই একটা। গোপালকে বিয়ের জন্য বলেবলে ক্লান্ত হয়ে গেছে হরিদাসী, ও ছেলে আদৌ বিয়ে করবে বলে মনে হয়না। কি আছে মাথায় ভগবান জানে। মেয়েটা থাকলে ওর শরীরটা একটু স্বস্তি পাবে। কিন্তু এতো আবার বোবা, কথা বলতে পারেনা! কিন্তু সোমত্ত একটা মেয়েকে বাড়িতে রাখলে আবার নানালোকে নানাকথা বলা শুরু করবে। উভয়সংকটে পড়ে হরিদাসী শেষপর্যন্ত ঘোষবাড়ির গিন্নির সাথে পরামর্শ করতে গেল। সব শুনে ঘোষগিন্নি বলল, “ রেখে দে, অনেক দিনতো কাজ করলি, এবার একটু আরাম কর। তোর গোপালের তো বিয়ে করার কোন সম্ভাবনা দেখছিনা যে বউ এনে আরাম করবি। কোনদিন না সাধু হয়ে যায় দেখ। ”   কুসুম থেকে গেল। কথা বলতে পারেনা ঠিকই , কিন্তু কাজেকর্মে দারুন ওস্তাদ। ঘরঝাঁট দেওয়া থেকে শুরু করে ছাগলের দুধ দোয়া সব কাজেই তুখোড়। হরিদাসীকে এখন কুটোটি নাড়তে দেয়না। শুরুতে হরিদাসীর সমস্যা হত। আকারে ইঙ্গিতে কি সব কথা বোঝান যায় ? কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই  দুজনের মধ্যে বোঝাপড়া হয়ে গেল দিব্যি। প্রথমটায় কুসুম কথা না বুঝলে শুধু দাঁত বের করে হাসত । এখনও হরিদাসীর কথা শুনে একবার হাসে তারপর ছুটে চলে যায়। হরিদাসীর কাছ থেকে পান খাওয়া শিখেছে আজকাল, বিকেলে চুল বেঁধে হরিদাসীর গা ঘেঁসে বসে পান চিবোয়। হরিদাসী ভাবে, মেয়েটা যদি কথা বলতে পারত , তাহলে গোপালের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেওয়া যেত। যদিও জাতপাত, মা-বাপের কোন খবর জানা নেই, তবে মেয়েটা যে ভাল সেটা হরিদাসীর জানা হয়ে গেছে এই কয়মাসে। লোকে কি বলবে এ নিয়ে বিশেষ আর মাথাব্যথা নেই ওর। লোকে নিন্দাচর্চা করলে করুকগে, কারুর মুখতো হরিদাসী বন্ধ করতে পারবেনা। কিন্তু গোপালের কাছে কথাটা কি ভাবে পাড়বে তাই নিয়ে ভাবছিল।
        বাজারের এক কোনায় গোপালের মুদিখানার দোকান। চালডাল থেকে শুরু করে তেল ,সাবান,ব্যাটারি সবই বেচে গোপাল। ছোট দোকান,কর্মচারী নেই, নিজেই সব। মাসে দুবার করে আড়তে যেতে হয় মাল আনার জন্য। পুঁজিও সামান্য,তার ওপর ধারের সমস্যা। গোপাল বিরক্ত হয়ে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে লিখে রেখেছিল “আজ নগদ কাল বাকি”, অবশ্য তাতে ধারের কমতি হয়নি কিছু। রবিবার ওবেলা বন্ধ থাকে দোকান, সেদিন মায়ের সাথে সুখদুঃখের গল্প হয়। রাতে খেতে বসে গোপালের মনে পড়ে গেল, কাল আবার আড়তে যেতে হবে। বেশ কিছু জিনিস বাড়ন্ত । মাকে বলল, “ কাল সকালে চরনের আড়তে যাব, তোমার কিছু আনার থাকলে বল। আর কুসুমকে রাখবে না ফেরত দিয়ে আসব?”  হরিদাসী ভুলেই গিয়েছিল ব্যাপারটা। কুসুম এ বাড়িতে আছে প্রায় দুমাস হতে চলল। এখন কুসুমছাড়া সংসারের কথা ভাবতে পারেনা হরিদাসী। কিন্তু কথায় সেটা বুঝতে দিল না। “ তোর যা ইচ্ছে” তারপর আবার যোগ করল, “ আমার কিছু সাহায্য হয় অবশ্য”
---“ তাহলে থাক। আরও কিছুদিন দেখে নাও।”
হরিদাসীর ইচ্ছে ছিল গোপালকে একটু বাজিয়ে দেখার, কিন্তু চেপে গেল তখনকার মত। থাক, পরে দেখা যাবে। আপাতত যেমন চলছে চলুক
    সুযোগ দেখে একদিন কথাটা পাড়ল রাত্রিবেলা।
--“ তুই কি বিয়ে করবিনা বলে ঠিক করেছিস?” হঠাৎ এই প্রশ্নে গোপাল অবাক।
--“কি হবে? এইতো ভাল আছি, তুমিও শান্তিতে আছ। কোথাকার কোন মেয়ে আসবে, সবাইকে জ্বালাবে ; তখন না সইতে পারবে না ফেলতে পারবে। ”
--“ সব মেয়ে খারাপ হয়না ”
--“ বেশির ভাগই তাই।”
--“ একটু খুঁজলে ভাল মেয়ে জোগাড় করা যেত ”
--“কোথায় পাবে? এ গ্রামে ভাল মেয়ে নেই। আর একদিন দেখে কি বোঝা যায় কে কেমন?”
---“ দুমাস ধরে দেখলে তো বোঝা যাবে?” হরিদাসীর চোখের কোনে প্রশ্ন। গোপাল ব্যাপারটা আঁচ করতে পারল। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কুসুমের কথা বলছ? ”
--“ মেয়েটা বড্ড ভাল, দুমাস ধরে দেখছি তো। কাজেকম্মেও চটপটে। দোষের মধ্যে শুধু বোবা এই যা। ” হরিদাসী যেন নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। গোপালের রাগ হলনা একটুও।
--“ কুসুম যেমন আছে থাকনা, আমি ওই ঝামেলায় যেতে চাইনা। তোমাকে বলেছি অনেকবার।”
--“ লোকে অনেক নিন্দাচর্চা করছে, সোমত্ত মেয়ে বাড়িতে। ”
--“ বেশ, তাহলে ফেরত দিয়ে আসি। ”
হরিদাসী আর কথা বাড়াতে সাহস করল না। আসলে তার গোপন ইচ্ছেটার কথা ও গোপালকে বলতে পারবেনাইচ্ছে ছিল, গোপাল বিয়ে করুক, নাতিনাতনি কিছু একটা হোক। কোলেকাঁখে নিয়ে একটু ফুর্তিআমোদে কাটুক বুড়োবয়সটা। কিন্তু সে দূর অস্ত। হরিদাসীর হাতে কিছু নেই। কপালে যদি এই লেখা তাহলে আর হরিদাসী কি করবে?
         দুমাস ধরে এই বাড়িতে আছে কুসুম, কিন্তু গোপাল ওর ধারেকাছেও ঘেঁষেনা। কথা বলেনা, মুখ তুলে তাকায়না পর্যন্ত। চা দিতে গেলে ইশারা করে টেবিলে রেখে দিতে। ভাবটা এই, কুসুম কোন মানুষই নয়। তিরিশ বছর বয়স, অথচ বিয়ে করার কোন ইচ্ছেই নেই। কুসুম মনে মনে ভাবে এ আবার কেমনতর পুরুষমানুষ। ভাত বেড়ে দেবার সময় কোনদিন ও ইচ্ছে করে শাড়ির আঁচলটা হালকা করে সরিয়ে রেখে দেখেছে, গোপালের কোন ভাবান্তর নেই। বোবা সে বটে, কিন্তু শরীরটাতো বোবা নয়। মাঝেমাঝে কলতলার দরমার বেড়া দেওয়া চানঘরে ও নিজেকে ছুঁয়ে দেখে। শরীরে হাত দিলেই গোপন ইচ্ছেটা জাগে, লোভ হয়। বোবা মেয়ের ভাগ্যে কি আর এসব আছে , কুসুম ভাবে। হরিদাসী মাঝেমাঝে কেমন ভাবে ওর শরীরের দিকে তাকায়, তখন কুসুমের ভয় হয়, মনেহয় হরিদাসী জেনে যাবে ওর গোপন ইচ্ছের কথা। তাড়াতাড়ি শরীর ঢেকে পালিয়ে যায় হরিদাসীর সামনে থেকে।
   রাত্তিরে হরিদাসীর ঘরে মেঝেতে শোয় কুসুম। গোপাল অন্য ঘরে। গোপাল বাড়িতে ফিরলেই খেতে বসে যায় ওরা। খেয়ে উঠে বাসনপত্র ধুয়ে, খাবার জায়গাটা মুছে ওর কাজ শেষ। হরিদাসী পান চিবোতে চিবোতে বারান্দায় ছেলের সঙ্গে কথা বলে কিছুক্ষণ, তারপর ঘুমোতে চলে যায়। গোপাল বসে বসে বিড়ি খায় আর কি যেন ভাবে একাএকা। কুসুমের ইচ্ছে হয় একটু পাশে গিয়ে বসে, বলে,  আমার সঙ্গে দুটো কথা বললে কি দোষ ? কিন্তু সাহস করতে পারেনা। নিজেনিজেই  ভাবে ও বসে আছে গোপালের পাশে, গোপাল একমনে বিড়ি খেয়ে চলেছে
--“ কেন এনেছ আমাকে এখানে? ”
--“ মায়ের জন্য, কাজের সুবিধা হবে বলে। ”
---“ আর কিছু নয়?”
--“ নাহ্‌, আর কি? ”
--“ আমার সাথে কথা বলনা কেন? ”
--“ কি বলব?  আমার কোন কথা নেই তোমাকে বলার। ”
---“ তুমি খুব নিষ্ঠুর, আমার জন্য কষ্ট হয়না তোমার? ”
--“ ভালই তো আছ, খাচ্ছ দাচ্ছ ঘুমোচ্ছ। কষ্ট কিসের? ”
--“ দেখে বোঝনা? ”
--“ নাতো ? তোমার কোন অসুখ হয়েছে ? ডাক্তার ডাকব ? ”
--“ হ্যাঁ, অসুখই হয়েছে। চোখ থাকলে দেখতে পারতে। ”
--“ আমার চোখে তো কিছুই পড়ছে না। ”
--“ তোমার চোখে পর্দা লাগান, পর্দাটা সরাও দেখতে পাবে। ”
--“ কি দেখতে পাব? ”
--“ এই যে আমি কষ্ট পাচ্ছি। ”
--“ কি করলে কষ্ট কমবে? ”
__” আমার চোখের দিকে তাকাও, তাহলেই বুঝতে পারবে।”

     একদিন মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল কুসুমের। হরিদাসী খাটে ঘুমোচ্ছে নাক ডেকে। বিদঘুটে স্বপ্ন দেখে ভয়ে কুসুমের গলা শুকিয়ে কাঠ। উঠে জল খেতে যাওয়ার সময় বারান্দা থেকে উঁকি দিল গোপালের ঘরে। পশ্চিমের জানালা খোলা, চাঁদের আলো ঢুকছে ঘরে। গোপাল অঘোর ঘুমে। পা টিপেটিপে কাছে গেল কুসুম। গরমে ফতুয়াটা খুলে ঝুলিয়ে রেখেছে আলনায়। পাশ ফিরে শোয়া খোলা পিঠের ওপর বিন্দু বিন্দু ঘাম, চাঁদের আলোয় চকচক করছে মুক্তোর মত। খোলা জানালার হাওয়ায় অচেনা মদির গন্ধ। কুসুমের মাথায় পাগলামি ভর করল। ধীরেধীরে খাটের কোনায় গিয়ে বসল। কামনায় ওর সারা শরীর এখন উন্মুখ, কুসুমের হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়ে যাচ্ছে। আলতো করে হাত রাখল গোপালের পিঠে , ঘামে ভিজে উঠল হাতের পাতা। নিজের দিকে তাকাল একবার, শাড়ির আঁচল খসে পড়েছে, উত্তেজনায় ওঠানামা করছে বুক। ঘুমের মধ্যেই পাশ বদলে চিত হয়ে শুল গোপাল। কুসুমের মাথার ভেতর বিস্ফোরণ ঘটে যাচ্ছে , এইবার ও স্বচক্ষে দেখতে পারছে কামনার গিরিশৃঙ্গ । আর কোন উপায় নেই, দুর্বারগতিতে নেমে আসছে জলোচ্ছ্বাস, ভাসিয়ে নিয়ে যাবে ওকে প্রচণ্ড স্রোতে। পাথরের টুকরোকে যেভাবে ভরাবর্ষার নদি চুরমার করে দেয় সেভাবে ও বিধধস্ত হতে লাগল , নদির কুল ছাপিয়ে বন্যার জল প্লাবিত করছে চারপাশ, হুঁশ নেই কুসুমের। গোপাল প্রথমটায় হকচকিয়ে গিয়েছিল, সংবিৎ ফিরে পেতেই ও দেখল নিজের অজান্তেই কুসুমের শরীরে মিশে গিয়েছে ওর পৌরুষ , অসহ্য সুখে ও কুসুমকে আঁকড়ে ধরল।
      মাসখানেক বাদে রান্নাঘরের পেছনে দাঁড়িয়ে বমি করছিল কুসুম। ইদানিং প্রায়ই গা বমিবমি করে, বিশেষত সকালের দিকেলেবুপাতার গন্ধটা খুব ভাল লাগে তাই একমুঠো লেবুপাতা আঁচলে বেঁধে রাখে। সুযোগ পেলেই গন্ধ শোঁকে। বমির শব্দটা হরিদাসীর কান এড়াল না , বারান্দা থেকেই চেঁচাল “অ কুসুম , এদিকে আয় তো।” কাছে আসতেই হরিদাসীর মনে হল কুসুমের শরীর ঠিক নেই, চোখের নিচে কালি। সপ্তাহ খানেক ধরে খাচ্ছেও না বিশেষ মেয়েটা। কাছে আসতেই পাশে বসাল কুসুমকে। থুতনিতে হাত দিয়ে ওর মুখের দিকে তাকাল স্নেহের চোখে। কুসুম অপরাধীর মত মুখ নামিয়ে নিল। হরিদাসী জিজ্ঞেস করল “ তোর শরীর খারাপ ? বমি করছিলি কেন?” কুসুম চোখ তুলে তাকাচ্ছেনা, অন্যদিনের মত আজ দাঁত বের করে হাসছেও না। হরিদাসী আগ্রহ করে আবার থুতনিতে হাত দিয়ে কুসুমের মুখটা তুলে ধরল। একি? কুসুমের চোখে জল কেন? দুই চোখের কোল ছাপিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে চিবুকেআহারে বোবা মেয়ে! কষ্টটাও বলতে পারেনা ঠিককরে। “ কি হয়েছে কুসুম ? বল আমাকে?” হরিদাসী আকুল হয়ে জিজ্ঞেস করল। এতক্ষণ কান্না আটকে রেখেছিল কুসুম, কিন্তু এবার সংযমের বাঁধ ভেঙে গেল। হরিদাসীর কোলে মুখ রেখে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল। কিছুকথা মেয়েদের বলে দিতে হয়না, তাছাড়া কমবয়সে কম আঁতুড়ঘর তোলেনি হরিদাসী। মুহূর্তের মধ্যেই ব্যাপারটা পরিস্কার হয়ে গেল ওর কাছে। কাঁধে ধরে সোজা করে কুসুমকে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “ কে সে? ”
    রাত্তিরে খাবার পর হরিদাসী বারান্দায় গিয়ে ছেলের পাশে বসল। নিঝুম হয়ে আছে চারপাশ। গোপালের ঘর থেকে হ্যারিকেনের  আবছা আলো বারান্দায় পড়ছে । উঠোনে ঘুটঘুটে অন্ধকার, ঝাঁক বেঁধে জোনাকিরা উড়ছে । আকাশে তারা নেই একটাও, আকাশ মেঘে ঢাকা বোধহয়। হরিদাসী খুব নিচু গলায় বলল, “ কুসুমের পেটে বাচ্চা এসেছে ।”  গোপাল আশ্চর্য হলনা। অন্তত হরিদাসীর তাই মনে হল। “ যে ভয়টা করছিলাম তাই হল। এখন আর কোন উপায় নেই। কুসুমের একটা বন্দোবস্ত করতে হবে তাড়াতাড়ি। গ্রামে জানাজানি হওয়ার আগেই। ” হরিদাসী চিন্তিত গলায় বলল। গোপাল অপরাধীর মত মাথা নিচু করে বসে আছে।
-“ কিছু বলছিস না যে? উত্তর দে। ”  অনেকসময় পর গোপাল নীরবতা ভাঙল।
  “ কি করতে হবে বল। ”
--“ আমাকে জিজ্ঞেস করছিস? তুই বল কি করা উচিত?”
--আমি কি বলব? তুমি যা বলবে তাই হবে।
-তাহলে কাল বাজার থেকে একটা নতুন শাড়ী, শায়া, শাঁখা, নোয়া  আর সিঁদুর  নিয়ে আসিস।  পরশুদিন পুরুতমশাইকে ডেকে মন্দিরে বিয়েটা সেরে ফেলতে হবে।
--“ঠিক আছে, তাই হবে।” গোপাল মাথা নাড়ল।

    হরিদাসী শুতে গেল। মেঝেতে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে কুসুম। হ্যারিকেনের আবছা আলোয় দেখতে পেল অঘোর ঘুমে মেয়েটা। মুখটা ঈষৎ খোলা, তেলচিটে পাতলা বালিশটা সরে গিয়েছে অন্যদিকে। অনাথ শিশুর মত দ্বিধাগ্রস্ত সারল্য ওর মুখে । আহা, বোবা মেয়েটা, কাল থেকে আর ওকে মেঝেতে শুতে দেবেনা হরিদাসী। বিছানায় নিজের পাশে শোয়াবে। আর মাত্র ছমাস, এরপরই ভগবান চাইলে নাতির মুখ দেখবে হরিদাসী। নিজের গোপন ইচ্ছেটা পূরণ হতে চলেছে, হরিদাসীর আজ আর ঘুম আসবে না। 

Comments

  1. besh laglo Debashish r choto galpa ta.

    ReplyDelete
  2. ন্রিপেনদা,
    নামের বানান ভুল, আমার কিছু করার নেই, অই রকমই আসছে।
    গল্পো টা ভাল লেগেছে বলে খূশী হোলাম।
    DEBASHIS

    ReplyDelete
  3. গল্পটি বেশ ভালোলেগেছে, তবে চরিত্রের সাথে সংলাপের ঐক্য প্রতিষ্ঠীত হয় নি; সংলাপ অভিজাত-শ্রেণির হয়ে গেছে।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

আলী হোসেনের ছোটগল্প। এক এক্কে এক।

এক এক্কে এক : ছোট্ট বেলা নামতা পড়ার সময় এভাবেই শুরু করত মান্তু। তখন জানতো না কি এর মানে, কেনই বা পড়তে হয়। মা বলতেন, নামতা হল অঙ্কের মাথা। কিম্বা মেরুদণ্ডও বলতে পারিস। এটা ঠিকঠাক না শিখলে অঙ্ক মেলে না। যখন প্রাথমিক স্কুল ছেড়ে মাধ্যমিকে পৌছেছে, তখন মায়ের কথার মানে বুঝেছে মান্তু। কিন্তু পরিণত বয়সে এসে, আজ বুঝেছে এর অন্য মানে। এটা না জানলে, জীবনের মানেটাই পালটে যায়। মিলতে চায় না জীবনের অঙ্কটাও। মান্তু তখন ক্লাস এইটে। হঠাৎই দুঃসংবাদটা এলো। ক্লাসে সেলাই দিদিমনি, ফ্রেঞ্চনটের গীট ধরে আটকানোর চেষ্টা করছেন। বোঝাচ্ছেন, কিভাবে একে কব্জা করতে হয়। মান্তু কিছুতেই এই গিঁটকে কব্জা করতে পারছেনা। মাথার ওপর বোঁবোঁ করে ঘুরছে পাখা, অথচ ঘামের স্রোতে ভাঁটার টান নেই মোটেও। বাইরের বাতাসে উত্তাপের পারদ নিশ্চয়ই লু-লেবেল ছাড়িয়েছে। বাতাসের শুষ্ক বুকে তরঙ্গ তুলে সে ছুটে চলেছে শরীর জুড়াতে আন্য কোথাও, অন্য কোনখানে। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে চাঁদনি থেকে দোকানের মাল নিয়ে ফিরছিল ফারহাদ। হঠাৎই চরকির মত ঘুরে গেল মাথাটা। পিচ-গলা রাস্তায় আছড়ে পড়লো মস্ত শরীর। পথ-চলতি নজর চকিতে ঘুরে এল ফারহাদের দিকে। কে বলে কলকাতার হৃদয়ে উষ্ণতার অভা

শুভ্রা সাহার ছোটগল্প। লকডাউন।

গল্পকারের কন্ঠে গল্প পাঠ। গল্পের নাম : লক ডাউনের গল্প গল্পকারের কন্ঠে গল্প পাঠ। গল্পের নাম : লক ডাউন গল্পকারের কন্ঠে গল্প পাঠ। গল্পের নাম : লক ডাউনের গল্প আলোচিতা এখন আর আগের মতো বোর হয় না। ঘরে বসেই ছোট বোন সঞ্চিতাকে নিয়ে অনলাইনে গান, বন্ধুদের সঙ্গে গল্প, বিভিন্ন প্রোগ্রাম করে সময় কাটিয়ে দেয়। লকডাউন-এ পড়ে কি যে নাজেহাল অবস্থা সকলের! মাত্র কয়েকদিন আগে, দিল্লি থেকে বাড়ি ফিরেছে সে। তখন তো ওর আসার কথাই ছিল না। হঠাৎ বাবার হার্ট অ্যাটাক হওয়াতেই আসতে হলো। আলোচিতা অর্থাৎ আলো। আর সঞ্চয়িতা অর্থাৎ সঞ্চিতা। ওরা দু'বোন। বাবা বিরাজবাবু স্কুলের শিক্ষক। মা রূপালি দেবী গৃহিণী। আলো দিল্লিতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেছে গতবছর। সঞ্চিতা দ্বাদশ শ্রেণীতে। শিক্ষকতা করার সুবাদে আলোর বাবা বিরাজ বাবুর এলাকায় যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। ওদের এলাকায় হিন্দু মুসলিমের সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি। বিরাজ বাবুর অনেক মুসলিম ছাত্রও আছে, যারা প্রায়ই ওনার কাছে আসে। বিভিন্ন মতামতের জন্য। বিরাজবাবু বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন। সুনাম

সুদীপ্ত ভাস্কর দত্তের ছোটগল্প। ২০২১ : করোনার পরে।

audio testing গল্পকারের কণ্ঠে গল্প পাঠ  ২০২১ : করোনার পরে নদীর জলটা এত টলটলে, পরিষ্কার আগে দেখিনি কোনদিন! পাড়ে বসে একটা মুগ্ধতা নিয়ে স্বগতোক্তি করল অরুণ। বসন্তের আরম্ভে এই মৃদুমন্দ বাতাসটা প্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছিল।। পড়ন্ত বিকেলে নির্জন নদীর তীরে, গাছের পাতার আড়াল থেকে একটা বউ কথা কও মাঝে মাঝে ডেকে উঠছিল। করোনা মহামারী রোধের চেষ্টায় সারা পৃথিবী জুড়ে যে লক ডাউন চলেছিল, তার ফলেই প্রকৃতি এখন দূষণমুক্ত, নির্মল।