Skip to main content

অপু চক্রবর্তী

বিট্টূ ও তার আমের আঁটি


প্রতিদিনের মতো আজ বিট্টু যখন গড়িয়ার তালতলায় চায়ের দোকানে কাজ করতে যাচ্ছিল তখন গনেশ ভবনের গেটের বাইরে একটা পাকা আম কুড়িয়ে পায়। বিট্টুদের বাদামতলার বাড়ির পাশে গনেশ ভবন, উচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা হর জেঠুর নিজের বাড়ি। বাড়ির ভেতরে চারপাশে আম, জামরুল, কাঁঠাল, বাতাবি লেবুর গাছ। বিট্টু ভাবল গতকাল রাতের ঝড়বৃষ্টিতে হয় তো আমটা পড়েছে। বেশ কয়েকদিন যাবৎ আমগুলিতে পাক ধরেছে। বিট্টু তা লক্ষ্য করেছে। বিট্টু জানে হর জেঠু পাকা আম পাড়ে না, কোন এক ছুটির দিনে কোন গেছো লোককে গাছে উঠিয়ে আমগুলি পেড়ে নেয়। পাড়ার কোন ছেলের আম পাড়ার ক্ষমতা নেই, কেননা রাতে গনেশ ভবনের গাড়ি-বারান্দার নিচে বুদ্ধ দারোয়ান পাহারা দেয়। আর দিনের বেলা হর জেঠূ গাড়ি-বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ার ফাঁকে ফাঁকে পাঁচিলের ওপর চোখ রাখে। বিট্টু একবারও চেষ্টা করে নি, কারণ তার মা হর জেঠুর বাড়িতে দুবেলা বাসন মাজার কাজ করে। ইন্দু জেঠি সময়ে সময়ে বিট্টুকে ডেকে হাত ভর্তি ফল ও এটা সেটা দেয়। তাছাড়া তার মা প্রায় প্রতিদিনই গাছতলায় পড়ে থাকা পড়তি-ঝড়তি কাঁচা আম এনে বাড়িতে ডাল রান্না করে।

আমটা পকেটে রেখে বিট্টু ভাবল, বাড়িতে গিয়ে ভাই-বোনে ভাগ করে খাবে। পরমুহূর্তে ভাবল আমটা পকেটে রেখে কাজে যাবে কী করে? দোকানের আর কাজের ছেলেগুলো বান্টা, পুকাই, কালু ওরা তো ভাগ বসাবে। ওরা বিট্টুকে বলেছিল, তুই একটা হাঁদা, তোর বাড়ির পাশে গনেশভবনের আম গাছে কত আম, নিজে না খাস, আমাদের জন্য তো পাড়তে পারিস। ওরা গনেশ ভবনের পাশ দিয়ে যেতে আসতে চোখ বড় বড় করে শুধু তাকায়। কী ভেবে বিট্টু পকেট থেকে আমটা বেরে করে গনেশ ভবনের পাশে হর জেঠুর নতুন তৈরি হতে থাকা ফ্লাট বাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে খোসা ছাড়িয়ে আমটা খেয়ে ফেলে।

আঁটিটা চেটেপুটে খেয়ে ঢিল ছোঁড়ার মত করে পাশের জঙ্গলে ছুঁড়ে ফেলতে গিয়ে গত কালের নাইট ইস্কুলের মাষ্টার মশাইয়ের কথাগলো মনে পড়লো। গতকাল মাষ্টার মশাই ওদের ক্লাসে পরিবেশ বিজ্ঞানের বইটা থেকে বোঝাচ্ছিলেন গাছের বীজ অঙ্কুরোদ্গম হয়ে কিভাবে গাছ বড় হয়, ফল ও ফুল দেয়। মাষ্টার মশাইয়ের এই কথা গুলোতো বিট্টু জানে। কিন্তু বিট্টু অবাক হয়ে গিয়েছিল মাষ্টার মশাই যখন বললেন, তোমরা জানো পরিবেশে গাছের কী অবদান? শোন তবে বলি, গাছ অক্সিজেন দেয়, কার্বনডাই অক্সাইট শুষে নেয়। বৃষ্টি আনে। মাটির ক্ষয় রোধ করে। বিট্টু আরও অবাক হয়েছিল মাষ্টার মশাই যখন বললেন, গাছেরও প্রাণ আছে। তারাও উত্তেজনায় সাড়া দেয়।

বিট্টু মাষ্টার মশাইকে বলেছিল, ওরা তো কথা বলতে পারেনা স্যার। মাষ্টার মশাই শুনে বললেন, তোমরা যখন উঁচু ক্লাসে পড়বে, তখন আরও জানতে পারবে। মাষ্টার মশাই আরও বলেছিলেন, কাল ২২শে এপ্রিল – বসুন্ধরা দিবস। এই দিনটায় তোমরা যদি প্রত্যেকে একটা করে গাছ লাগাও তাহলে প্রকৃতির কাছে তোমাদের একটা বড় অবদান হয়ে থাকবেপরিবেশ বাঁচাতে গেলে যে খুব বড় কাজ করে দেখাতে হবে ত নয়, আমাদের ছোট ছোট পদক্ষেপ পৃথিবীর কাছে অতি প্রয়োজনীয় রক্ষাকবচ হয়ে উঠতে পারে। বিট্টুর মনে পড়ে মাষ্টার মশাই বলেছিলেন, আমদের পৃথিবীটা নাকি ক্রমশ গরম হয়ে উঠছে। আবহাওয়া দিনকে দিন পালটে যাচ্ছে। পৃথিবীর অনেক দেশে বড় আকারে ঝড় সুনামী হচ্ছে। সমুদ্র নাকি সময়ে সময়ে উত্তাল হয়ে উঠতে পারে। দেশে দেশে বড় শহরগুলো নাকি জলে ডুবে যেতে পারে। এরকম আরও অনেক কিছু গতকাল মাষ্টার মশাই বলছিলেন। বিট্টুর মাষ্টার মশাইয়ের শেষের দিকের কথাগুলি মনে পড়তেই বিট্টু কেমন যেন মনমরা হয়ে পড়ে। মাষ্টার মশাই বলেছিলেন, এই গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর জন্য নাকি মানুষই দায়ী। মানুষ নাকি প্রকৃতিকে নানাভাবে অত্যাচার করে চলেছে। প্রতিনিয়ত মানুষ তার ভোগের জন্য গাছ কেটে চলেছে। বড় বড় কলকারখানা থেকে নির্গত নানা গ্যাস আবহাওয়াকে দূষিত করছে। খাল, বিল, পুকুর বুজিয়ে ফ্লাট বাড়ি, কলকারখানা বানাচ্ছে। নানা অত্যাধুনিক ভোগদ্রোব্যের নির্যাস পরক্ষভাবে ওজনস্তরে মিশছে।

আঁটিটা হাতে নিয়ে মাথা পেছনের দিকে হেলিয়ে হরজেঠুর চারতলা ফ্লাটটার দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে বিট্টু – হর জেঠু কেন এত বড় বড় বাড়ি বানায়? বিট্টু জানে এই জায়গায় হর জেঠুর আরও একটা বাগান ছিল। এই সেদিনও বিট্টুরা লুকোচুরি খেলতে খেলতে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ত এই বাগানটাতে। একটা সদ্য কাটা নারকেল গাছের গুড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বিট্টু ভাবছিল মাষ্টার মশাইয়ের আরও কথা। মাষ্টার মশাই বলেছিলেন, এখন আবহাওয়া উত্তপ্ত হয়ে ওঠার অনেকগুলি কারণের মধ্যে গাছ কেটে ফেলা একটা অন্যতম কারণ। বিট্টুর মনে পড়ে, তার দাদু বলেছিল গনেশভবনের পশ্চিম দিকের জাম গাছটা কেটে ফেলার পর বিট্টুদের টালির ঘর দুটো গরম হয়ে উঠেছে। দাদু বলত, ঐ গাছটা ওদের ঘর দুটোয় ছায়া ফেলে ঘরটা ঠাণ্ডা রাখত। বিট্টু ভাবল, হর জেঠুকে কি তার মাষ্টার মশাই গাছেদের উপকারের কথা বলে দেয় নি।

বিট্টু তার এই দশ বছর বয়সেই দেখেছে তাদের পাড়াতেই কত আস্ত আস্ত বাড়ি ভেঙে বড় বড় ফ্লাট হয়েছে। বিট্টু অনায়াসে কত ফ্লাটের নাম বলে দিতে পারে – বিনায়ক, বাসুদেব, বোধন, অঙ্কুশ আরও কত। বিট্টুর মা যে ফ্লাটে কাজ করে বিট্টু একবার সেই ফ্লাটের ভিতরে গিয়ে দেখেছে, মেঝেটা কত পিছল, বাথরুমের দেওয়ালে আট-দশটা কল, মাথার ওপর ঝাঝরি দেওয়া কল। বারান্দায় সবুজ রঙের প্লাষ্টিকের লতানো গাছ।

কি-এক ভেবে বিট্টূ আঁটিটা চটপট পকেটে পুরে ফেলে। ঠিক করে, আজ আর কাজে যাবে না। বাড়ি ফিরে এসে ঘরের ভিতর থেকে একটা শাবল বের করে এনে গনেশ ভবনের উলটো দিকে বড় রাস্তার কলপাড়ের কাছে গর্ত খুড়তে লাগলো। বিট্টুর বোন কাছে আসতেই বিট্টু বলল, এক ঘটি জল নিয়ে আয় তো, গাছ পুঁতবো।

বিট্টূ আজ কাজে যায় নি বলে দোকানের মালিক পরেশদা বান্টা আর পুকাইকে পাঠিয়েছে, বিট্টু আজ কাজে যায় নি কেন তার খবর নিতে। ওরা বিট্টুর কাছে এসে দাঁড়ালো। পুকাই জিজ্ঞাসা করল, এখানে গর্ত করছিস কেন? বিট্টু ওর কথার কোন উত্তর দেয় না, আপন মনে গর্ত করতে করতে মাষ্টার মশাইয়ের কথা ভাবতে থাকে। মাষ্টার মশাই বলেছিলেন, ২২শে এপ্রিল সারা পৃথিবীর তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। আবহাওয়ার পরিবর্তন, জলের অপ্রতুলতা, পৃথিবীর উত্তপ্ত হয়ে ওঠা, এরকম নানা প্রাকৃতিক সমস্যার সমাধান বেরিয়ে আসুক নতুন প্রজন্মের সাহস, উদ্দিপনা ও কল্পনাশক্তির অসামান্য উদ্ভাবনী কৌশলে

বাণ্টা জিজ্ঞেস করল, কাজে গেলি না কেন?

বিট্টু পকেট থেকে আমের আঁটিটা বের করে ওদের দেখিয়ে বলল, কাজে গেলে এই দামি জিনিসটা কি থাকত!

Comments

Popular posts from this blog

আলী হোসেনের ছোটগল্প। এক এক্কে এক।

এক এক্কে এক : ছোট্ট বেলা নামতা পড়ার সময় এভাবেই শুরু করত মান্তু। তখন জানতো না কি এর মানে, কেনই বা পড়তে হয়। মা বলতেন, নামতা হল অঙ্কের মাথা। কিম্বা মেরুদণ্ডও বলতে পারিস। এটা ঠিকঠাক না শিখলে অঙ্ক মেলে না। যখন প্রাথমিক স্কুল ছেড়ে মাধ্যমিকে পৌছেছে, তখন মায়ের কথার মানে বুঝেছে মান্তু। কিন্তু পরিণত বয়সে এসে, আজ বুঝেছে এর অন্য মানে। এটা না জানলে, জীবনের মানেটাই পালটে যায়। মিলতে চায় না জীবনের অঙ্কটাও। মান্তু তখন ক্লাস এইটে। হঠাৎই দুঃসংবাদটা এলো। ক্লাসে সেলাই দিদিমনি, ফ্রেঞ্চনটের গীট ধরে আটকানোর চেষ্টা করছেন। বোঝাচ্ছেন, কিভাবে একে কব্জা করতে হয়। মান্তু কিছুতেই এই গিঁটকে কব্জা করতে পারছেনা। মাথার ওপর বোঁবোঁ করে ঘুরছে পাখা, অথচ ঘামের স্রোতে ভাঁটার টান নেই মোটেও। বাইরের বাতাসে উত্তাপের পারদ নিশ্চয়ই লু-লেবেল ছাড়িয়েছে। বাতাসের শুষ্ক বুকে তরঙ্গ তুলে সে ছুটে চলেছে শরীর জুড়াতে আন্য কোথাও, অন্য কোনখানে। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে চাঁদনি থেকে দোকানের মাল নিয়ে ফিরছিল ফারহাদ। হঠাৎই চরকির মত ঘুরে গেল মাথাটা। পিচ-গলা রাস্তায় আছড়ে পড়লো মস্ত শরীর। পথ-চলতি নজর চকিতে ঘুরে এল ফারহাদের দিকে। কে বলে কলকাতার হৃদয়ে উষ্ণতার অভা...

মুর্শিদ এ এম - এর গল্প। ঠুনকো।

পুরো গল্প পড়তে গল্পকারের নাম -এর ওপর ক্লিক করুন ।। হোম পেজ-এ যেত এখানে ক্লিক করুন audio testing গল্পকারের কণ্ঠে গল্প পাঠ।  ঠুনকো একের পর এক প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে একেবারে দক্ষিণে, মনে হচ্ছিল একটু গেলেই সাগর এগিয়ে আসবে, একলা ত্যাজ্যপুত্রের মতো দাঁড়িয়ে থাকা এক্সপ্রেস ট্রেনটা দেখতে পেল ইয়াসিন। সাউথ ইন্ডিয়া যাবার প্রায় সব ট্রেন এই দিকের প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়ে। বন্যার কারণে কয়েকটি ট্রেন বাতিল হওয়ার পর কদিন হল খুলেছে। একাই এতটা পথ লটবহর টেনে গলদ্ঘর্ম হয়ে কামরায় ঢুকে নিঃশ্বাস ফেলল সে। এখনও এ সি চলেনি। চললে অসুবিধেই হত, হঠাৎ লেগে যেত ঠান্ডা। নিজের সিট খুঁজে মালপত্র রেখে চোখ-মুখ ধুয়ে, টুপিটা খুলে আবার পরে নিয়ে, ঘন সুবিন্যস্ত দাড়ি ভেজা হাতে মুছে খানিকটা জল খেয়ে স্বস্তি পেল যেন। একটা কালো ঢাউস ব্যাগকে কিছুতেই কব্জা করতে না-পেরে পায়ের কাছেই রেখে দিল ইয়াসিন।

নয়ারুণ ভট্টাচার্য্য

রেবন্তর স্ববধবিলাস ‘No one ever lacks a good reason for suicide’         - Cesare Pavese (1908-50) কাল এক দীর্ঘ, দীর্ঘ রাত্রিব্যাপী পরিক্রমায় গৃহত্যাগ করিব। পরিক্রমার অন্তে দেখিব তরঙ্গবিক্ষুব্ধ এক অপার জলধি। মৃত্যু কী এমনই দেখিতে? ভাবিলেও রোমাঞ্চকণ্টকিত