Skip to main content

তাপস দাস

চিত্ত দর্পণ

গ্রাম বাংলার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভূপতিবাবুদের আড্ডাখানা আজও আছে। সবুজে ঘেরা মেঠো পথের পাশে পাশে মাচার মজলিস যুগ যুগ ধরে বিরাজমান। গ্রীষ্মের দাবদাহ, মাটির সোঁদা গন্ধে ভরা দুরন্ত বর্ষণবেগ,উৎসব মুখরিত শরতের আওয়াজ,শিশিরে ভেজা হেমন্ত, শীতের কামড়,বসন্তের মদন বাতাস সবকিছুর মধ্যে সগর্বে দাঁড়িয়ে থাকে এই সব আড্ডাখানা গুলি।

পাড়ায় থাকেন অমিয় ডাক্তার। তিনি গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্বাচিত জনপ্রতিধিও। তাঁর সুদৃশ্য অট্টালিকার এক পাশে সুউচ্চ বট গাছ দাঁড়িয়ে প্রাচীনতার গৌরব বহন করে। গ্রীষ্মের দাবদাহকে পরাজিত করে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করার জন্য, কিছুটা মোসাহেবি করার জন্য আশেপাশের কয়েকটি পাড়া থেকে কেষ্ট বিষ্টু থেকে হরিদাস পালদের আনাগোনা চলতে থাকে।

পাশের একটি পাড়ায় রনজিৎ ডাক্তার বাস করে। সত্যিই ডাক্তারিবিদ্যা তার জানা আছে কিনা কেউ মন থেকে মানতে চায় না মানুষের একটি মস্ত গুণ আছে। আমরা যাকে পছন্দ করি না তার কোন গুণের কথা কেউ বললে আমরা ফুৎকারে উড়িয়ে দিই।সে গুলি পৃথিবীর সব থেকে বেশি অসম্ভব ঘটনা মনে করে পুলকিত হই। আবার তার কোন ত্রুটি সম্পর্কে আলোচনা করতে আসলে আমরা আরো দশটি ত্রুটি খুঁজে দিই।অনেক সময় সে কি করে, কি খায় কোথায় যায় এই সমস্ত ব্যাপার সে যা বলবে তা বিশ্বাসযোগ্য হয় না,তার শত্রুপক্ষই সঠিক কথা বলতে পারে আসলে কারো ভালো হয়েছে এটা বিশ্বাস করতে আমাদের যত কষ্ট তার ক্ষতি হয়েছে একথা বিশ্বাস করতে আনন্দ কয়েকগুণ বেশি। সেই জন্য সরিষার তেলসিক্ত চুলের কালো বেঁটেখাটো চেহারার  মালিক   রনজিৎকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করেই সবাই পুলকিত হয়।কারোর ঠাট্টার বহর দেখে প্রতুত্তর দিলে সে উগ্র, না দিলে সে ভ্যদা।এহেন রনজিতের জন্য অমিয়বাবুর মজলিসের একটি আসন বরাদ্দ মজলিসের মানুষ গুলোর প্রত্যেকে কোনও না কোনও বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিণ্টন সহ সমস্ত রকম খেলা, রাজনীতি, অর্থনীতি, বিদেশ, সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, প্রযুক্তি সমস্ত বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা যায় সেই মজলিস থেকে। এহেন মজলিসে একটু রস আনার জন্য রগড়ানোর জন্য রনজিৎকেই চায়।

একদিন বৈঠকখানায় ক্রাইম ও প্রশাসন নিয়ে আলোচনার সূত্র ধরেই কল্পবিঞ্জানের উদয় হল। অর্ণব ছেলেটি রসায়ন বিদ্যায় অনার্স নিয়ে পাশ করেছে বিঞ্জানের নতুন নতুন আবিষ্কার সম্পর্কে তার আগ্রহ অকৃত্রিম। কৃত্রিম ভাবে মেঘ সৃষ্টি করে সেটিকে ইচ্ছামত স্থানে নিয়ে গিয়ে বৃষ্টিপাত ঘটানো যায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পে বর্ণিত এই মতবাদ সে উড়িয়ে দিতে পারে না।
--কি আবোল তাবোল বকে যাচ্ছিস? সুরজিৎ চেঁচিয়েই প্রতিবাদ জানাল। তাহলে তো পৃথিবীতে কোন মরুভূমিই থাকবে না। সাধারণত রনজিৎকে চুপচাপ থাকতে হয়। সে মুখ খুললেই সবাই রে রে করে ওঠে। সে না আসলে কারো আনন্দ হয় না তাই অমিয়বাবুর জোরাজুরিতে তাকে আসতেই হয়। তবু অর্ণবের মুখ থেকে 'তা কি করে হবে?গরম কড়াই তে এক চামচ জল ঢালা আর মরুভূমিতে কৃত্রিম ভাবে বৃষ্টি ঘটানোর ফলাফল একই হবে' কথাটি শুনে সবাইকে অবাক করে বলে উঠল 'যদি বার বার অনেক বেশি পরিমাণে বৃষ্টিপাত ঘটানো হয় এবং মৃত্তিকা জৈব উপাদান যোগ করে কিছু বৃক্ষ রোপন করা যায় তাহলে একটা বাস্তুতন্ত্র গড়ে উঠতেই পারে' ব্যস, শুরু হয়ে গেল কীর্তন। "আরে আরে আরে রনজিতা বলে কি? বার বার বৃষ্টি ঘটাবে মরুভূমিতে?"-অর্ণবই উদ্বোধন করল। সুরজিৎ ও কম যায় না "আরে রনজিতার (ওকে এই নামেই ডাকে ) মত মহাপুরুষের মুখ থেকে যখন বেরিয়েছে তখন অসম্ভব নয়। রোহিত "চল সবাই কৃত্রিম মেঘ তৈরি করি। বৃষ্টিপাত ঘটানোর দায়িত্ব আমার অমিয়বাবু সবসময়ই নিজেকে  নেতৃত্বপদে রাখতে ভালবাসেন । তাই মরুভূমিতে গিয়ে কে বৃষ্টিপাত ঘটাবে সেটা তিনিই ঠিক করে দেবেন "থাম রোহিত। তোর ক্ষমতা কতখানি? ডাক্তার সাহেবের চেয়ে বেশি ভাল ভাবে এই কাজটি কেউ করতে পারবে না। ডাক্তার সাহেব, তুমি কাজে লেগে পড়, নোবেল পুরস্কার তোমার জন্য বাঁধা।" নিজের কথায় নিজেই বেশি পুলকিত হয়ে একটা অট্টহাসি দিলেন । বাকিরা হাততালি দিয়ে মোসাহেবির কাজটি সম্পন্ন করল। বঙ্কুবাবুর মতই তারও ছাতাটা জুতোটা মাঝে মাঝে গায়েব হয়ে যেত। তখন প্রিয়জনের মৃত্যু খবর শোনা ব্যক্তিদের চেয়েও অসহায় হয়ে উঠত রনজিৎ। বিঞ্জানের উন্নত ছাত্রটি তাকে উপদেশ দিত "তুমি তো সায়েন্স নিয়ে পড়তে। দেখি তোমার মাথায় কত বুদ্ধি আছে, তোমার জুতোটা খুঁজে বের কর।"
"আমি গোয়েন্দা নই" একথাটা বলার সাহস আর তার হত না ।

আর্থিক অনটন নেই, নেই কোনও ললনার প্রেমাঘাত, তবু পৃথিবীর সব রকম দুঃখের বড় আড়ৎদার সে যার দ্রব্যের কোনো ক্রেতা নেই । তার জন্য বরাদ্দ শুধু অপযশ কারো কাছে সে পাগল, কারো কাছে শয়তান, তার স্বভাব চরিত্র ও সুবিধাজনক নয়, সে কথা ঠিকঠাক বলতে পারে না, পোশাক-আশাক চলনসই নয় ইত্যাদি ইত্যাদি জনশ্রুতি ভাসমান । তাকে দেখে টিপ্পনী কাটার জ্ঞানীগুণী মানুষের অভাব নেই সবাইকে এড়িয়ে চলার সে যতখানি চেষ্টা করে সবাই তার সান্নিধ্য লাভের জন্য চেষ্টা করে অনেকগুণ বেশি

অমিয়বাবুর মাতৃবিয়োগ হয়েছে। শ্রাদ্ধ-শান্তি ঘিরে চারিদিকে বিস্তর আলোচনা চলছে বিগত কয়েক দশক জুড়ে এমন দেদার আয়োজন কেউ কোথাও দেখেনি। কম করেও বারোশ' লোকের পাত পেড়ে কব্জি ডুবিয়ে চর্ব্য চূয্য লেহ্য পেয় সবকিছুর আস্বাদ গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। চারিদিকে ধন্য ধন্য সাড়া পড়ে গেল মজলিসের সদস্যদের উপস্থিতি ছিল একশো শতাংশ রনজিতের উপস্থিতিটা ছিল পৃথক রকম অমিয়বাবুর বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়ে তাকে আবিস্কার করে পাকড়াও করে বাড়িতে আনা হলে রনজিত বিস্ময়ের সীমা থাকল না, অন্যদিকে মায়ের আত্মার শান্তি কামনার অনুষ্ঠানে তাকে পেয়ে অমিয়বাবুর আহ্লাদের পরিসীমার বেড়া গেল ভেঙে। প্রথমজন তাকে টেনে হিঁচড়ে আনতে উদ্যোগী ব্যক্তিকে অনুষ্ঠানে সে নিমন্ত্রিত নয় এটা বোঝানোর চেষ্টা করেও শরীরকে চালিত করল দ্বিতীয়জনের অট্টালিকা প্রাঙ্গনে। দ্বিতীয়জন তৎক্ষণাৎ প্রথমজনকে তাঁর গৃহের মালিকানা সমর্পণ করে বসল। "নিজের বাড়িতে আসতে কারো আমন্ত্রণের প্রয়োজন হয় ?"
প্রত্যুষ ছেলেটি তার মিলিটারি মেজাজে ধমক দিয়ে উঠল "তুমি কি হে? তোমার মত মানী লোকের কদর অমিয়বাবু করবেন না ভাবলে কি করে?" রনজিৎকে নিজের নিজের পাশে বসানোর জন্য তাদের মধ্যে কাড়াকাড়ি লেগে গেল। তার মত মানী লোকের সান্নিধ্য লাভের উদগ্র বাসনা সবার আছে যে শেষ পর্যন্ত তাকে যে ভাবে আপ্যায়ন করা হল তা যেকোন মানুষের মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে ঠেলেঠুলে খাবার টেবিলে বসানো তো হল। সবাই তৃপ্তি করে খাচ্ছে হঠাৎ অমিয়বাবুর ছেলেটা বিশেষ ধরনের রং এনে রনজিতের গালে লেপ্টে দিল।
--"আজ কী দোল না কি হোলি? "--অবাঞ্ছিত বিরক্তিতে সে মৃদুস্বরেই বলে ফেলল। রনজিতের প্রতিবেশী জনাব মোক্তার ও সেখানে ছিলেন। রনজিৎকে সবাই যে ভাবে খাতির যত্ন করে তা তিনি মানতে পারেন না, তিনি মনে মনে কাতর হন , রনজিতের নিজেকে পাল্টে পুরুষসিংহ হয়ে উঠতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি তাকে রনজিতের মাকে বলতে শোনা যায়। সেই তিনিও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নিদর্শন রাখতে হোলি খেলারই নিদান দিলেন ।
- "ভাইপো কয়দিনের এই জীবন? সবার সাথে মিলেমিশে আনন্দ করে কাটিয়ে দাও না! আমি মুসলিম হয়ে বলছি আর তুমি বাধা দিচ্ছ কেন? হয়ে যাক, হয়ে যাক হোলি "এক বাটি ডাল পুরোটাই রনজিতের মাথায় ঢেলে দিয়ে সুরজিৎ ও চেঁচিয়ে উঠল, "ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত।" ডাল, রসগোল্লার রস, চাটনি, ভাতের ফ্যান ইত্যাদি সহযোগে শরীর মন পূর্ণ করে তার সাথে সবার হোলি খেলা যখন শেষ হল তখন সে ক্লান্ত বিধ্বস্ত। টলমল শরীরে বাড়ি পৌঁছালে আরেক বিপত্তি। তার এই ভাবে রঙের উৎসব উদ্‌যাপন মাকে খুশি করতে পারল না। তিনি জানেন বোঝেন এই অকাল হোলি খেলার গভীর অর্থ তিনি যখন তার আলাভোলা ছেলের লাঞ্ছনা গঞ্জনার ইতিবৃত্ত ফুঁপিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে লাগলেন রনজিতের ধৈর্যের সংকুলান ঘটল। এমনিতেই তার আজ লাঞ্ছনার মাত্রা ছিল সীমাহীন, তারপর মায়ের মুখে গঞ্জনার বারমাস্যা তার কাছে অধিক বিরক্তিকর অপমানজনক মনে হল প্রবল ক্রোধে ক্ষোভে প্রবল বিক্রমে মাকে ভূপতিত করে তার দুই বাহু প্রসারিত হয়ে মায়ের গলার দিকে ধাবিত হলে সে সন্বিৎ ফিরে পায়। 'মাকে ভূমিতে নিক্ষেপ করে গলা টিপে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল ' এর মত লাঞ্ছনা আর কি হতে পারে? সবকিছু মিলিয়ে সে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিল। অনেক দিনের জমানো ব্যথা বেদনার পুঞ্জীভূত মেঘ আজ ঘনীভূত হয়েছে। তার পতন রোধ করা গেল না। তার সঙ্গে যোগ হল হৃদয়ের গভীর নিম্নচাপ জন্মের পর থেকেই সে দেখে এসেছে জুতো সেলাই করে বাবার উপার্জন থেকে সংসার চলে না মা লোকের বাড়ির ঘুঁটে দিয়ে, গরুর বিচালি কেটে, বাবার সাথে বাড়িতে ঠোঙা তৈরি করার পর পুকুরের কলমী শাক, বুনো কচুর লতি, তেলাকুচো পাতা কুড়িয়ে এনে রান্না করে পরম যত্নে থালায় সাজিয়ে তাকে খাইয়েছে। যেদিন একটু মাছ অথবা মাংসের যোগান হয় সেদিন তাদের আহ্লাদের সীমা থাকে না। সেদিন মা প্রায় অর্ধেকটা তার জন্য রাখে। এই নিম্নচাপের জেরে বারিবেগ বেড়ে গেল। সন্ধ্যার পরে নিম্নচাপের শক্তি কমে বৃষ্টির ধারা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে মিলিয়ে গেল। গভীর রাত থেকে হৃদয়ে উচ্চচাপের উদয় হল। ভবিষ্যতে সে বাবা মায়ের একমাত্র আশ্রয়স্থল। সে হবে বাবা মায়ের অভিভাবক অনেক উপার্জন করবে, সুন্দর বাড়ি বানাবে, সমালোচকদের উপযুক্ত জবাব দেবে ইত্যাদি ইত্যাদি ।


প্রবল ঝড় শুধু নিম্নচাপের জেরে হয় না, উচ্চচাপেও প্রবল ঝড় হতে পারে যদি আশেপাশের কোন স্থানে নিম্নচাপের উদয় হয়। রনজিতের মনে তৈরি হওয়া রাতের গভীর উচ্চচাপ বিরাট ঝড়ের আকার নিয়ে অমিয়বাবুর মজলিসের নিম্নচাপের দিকে ধাবিত হল। মন যখন প্রবল বেগে জীবনের ইতিহাসের দিকে ধাবিত হয় সেটি নিম্নচাপ আবার নিম্নরুচির জনসমষ্টিও নিম্নচাপ । পরের দিন সকালে রনজিতের ঝড়ের বেগ ছিল স্লগ ওভারে মারকুটে ব্যাট্সম্যানের ইনিংসের মত প্রত্যুষকে ফেল্টুস, সুরজিৎকে বেসুরোজিৎ, অমিয়বাবুকে মিঁয়াওবাবু ইত্যাদি বিশেষণ দিয়ে অমিয়বাবুর ছেলের পিঠে দুম করে কিল মেরে বেগ কমিয়ে দিল। প্রবল ঝড়ের পরে সবাই ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমে পড়ে। এখানেও তার ব্যতিক্রম হল না। প্রত্যুষ বাজখাঁই গলায় বলল, "বড্ড ফালতু বকছিস কিন্তু ।সাহস বেড়েছে দেখছি।" একটু দমকা হাওয়া তাকে বলল,"আমি ফালতু বকছি না। ফালতু তো তুই কত বার করে একেক ক্লাসে ফেল করেছিলি মনে আছে? ফেল্টুস কোথাকার! গণ্ডগোলের উপক্রম দেখে অমিয়বাবু হস্তক্ষেপ করলেন, "রনজিৎ বাবু একটু চটে আছেন দেখছি এ অধমদের অপরাধ জানতে পারি কী?"আরে আপনার তো সব কথায় মিঁয়াও মিঁয়াও করা স্বভাব কোনদিন আয়নাতে মুখ দেখেছেন? মুখের চামড়ায় ভাজ ধরেছে অথচ বাচ্চাদের বিরক্ত করার স্বভাব গেল না ---দিগ্বিদিক বিবেচনা না করেই বলে উঠল। সুরজিতের মাথায় যেন বিদ্যুত খেলে গেল সে তড়িৎ গতিতে রনজিতের দিকে এগিয়ে গিয়েই কলার টেনে বিরাশি সিক্কার থাপ্পর মেরে বলল,"কোন দিন আয়নায় নিজের মুখ দেখেছিস ?হনুমান কোথাকার "আয়না?হ্যঁ ঠিক বলেছিস। আমি আজকে তোদের সামনে একটা আয়না হয়ে দাঁড়িয়েছি যে আয়নাতে তুই নিজেকে বেসুরোজিৎ বলে চিনতে পেরেছিস। শুধু তুই না, তোদের সবার স্বরূপ চিনতে পারছিস। একেকটি নোংরামিতে পূর্ণ ডাষ্টবিন। তাই আমার উপর রেগে যাচ্ছিস । তোর নাম সুরজিৎ কেন? তোর অসুর মার্কা বেসুরের চেয়ে শিয়ালের হুক্কাহুয়া অনেক ভালো ---এক দমে কথা গুলি বলে ক্ষান্ত হল রনজিৎ। বিঞ্জানের সেই উন্নত ছাত্রটির হঠাৎই মনে হল রনজিৎকে একটু প্রেস্টিজ দিয়ে কথা বলা উচিৎ। সবাইকে চমকে দিয়ে বলে উঠল, রনজিৎদার কথা শুনে আমার একটা দারুণ আইডিয়া মাথায় এসেছে। যদি এমন কোন আয়না আবিষ্কার হত যেটি কারো সামনে ধরলে তার বদ স্বভাব গুলি আয়নাতে ধরা যেত তাহলে ব্যাপক হত ব্যাপারটা। রোহিতেরড়ও এরকম কল্পনাটিকে চমকপ্রদ মনে হল। "তাহলে পুলিশ প্রশাসন ,সিবিআই, সিআইডি সহ সবরকম অপরাধ দমন বিভাগের কাজে ব্যাপক সুবিধা হত। কোন অপরাধীরই কৃত অপরাধ অস্বীকার করার উপায় থাকত না"--রোহিত দৃপ্তকণ্ঠে বলল। আবার পুলিশের ঘুষ নেওয়ার সুবিধাও এতে বাড়বে কারণ অপরাধীর ছাড়া পাওয়ার অন্য উপায় থাকবে না সেটাও বিশ্লেষণ করতে ভুলল না। অপরাধ বিঞ্জানে প্রত্যুষের মস্তিষ্ক একটু বেশিই খোলে। তার মনে হল তাতে সব অপরাধীর কাছে পুলিশের পৌঁছানো সম্ভব হবে না । পুলিশ ধরবে তারপর তো সামনে আয়নাটা ধরবে। তাই এতে অপরাধের সংখ্যা খুব একটা কমবে না। সুরজিৎ অনেকটা দার্শনিকের মত কথা বলল,"এই আয়না তৈরি হলে সব মানুষ জানতে পারবে তার দোষ ত্রুটি গুলো। তখন প্রত্যেকেই ভালো হওয়ার চেষ্টা করবে। জেনেবুঝে খারাপ হতে চাইবে কেন?" অমিয়বাবু দেশের নেতা না হলেও দশের নেতা তো বটে। দশজনের কথা সবসময়ই তাকে ভাবতে হয়। সেই ভাবনা থেকেই তাকে বলতে হয় "তাহলে তো অনেক মানুষ বেকার হয়ে যাবে পুলিশ গোয়েন্দা বিভাগে নিয়োগ বন্ধ হয়ে যাবে। যারা আছে তাদের ও অধিকাংশ ছাটাই করতে হবে।" এবারে রনজিত আবার কথা বলল,"মানুষ নিজের অপরাধ বুঝতে পেরে অপরাধ করা ছেড়ে দেবে? বেসুরোজিতের যা বুদ্ধি! আরে মানুষ এই আয়নাতে যখন নিজের অপরাধ মনস্কতা দেখতে পেলে রেগে যাবে। তার যে ঐরকম বদ স্বভাব আছে মানতেই চাইবে না। আয়নার গুণমানই বিশ্বাস করতে চাইবে না। পুলিশ এটাকে ব্যবহার করে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে চাইলে সারা পৃথিবী জুড়ে আন্দোলন হবে। মোমো,ব্লু হোয়েল গেমের আবিষ্কর্তাদের মতই এই আয়নার আবিষ্কর্তাও অপরাধীর পর্যায়ভুক্ত হবেন। সবাই তো আজই দেখল আমি সবার স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে সবাই কেমন রেগে গেল?" অমিয়বাবুর মজলিসে রনজিতের সেদিন ছিল শেষ যাওয়া। সেদিন সেখানে সে জিতে গেল।কিন্তু অমিয়বাবু ওতার মোসাহেবদের সেদিনের পরাজয় রনজিতের ভবিষ্যতে বিষম বিড়ম্বনা সৃষ্টি করল। তার পক্ষে রাস্তায় চলাফেরাটা কষ্টকর হয়ে উঠল। মোড় গুলিতে স্বঘোষিত উন্নতশির মানবগোষ্ঠী তীব্র বিষাক্ত বাক্যবাণে তাকে বিদ্ধ করতে থাকলে সে নিজেকে কিছুটা ঘরবন্দী করে রাখতে অভ্যস্ত হল। পৃথিবীর নিকৃষ্টতম ব্যক্তিতে পর্যবসিত হল।

এই ঘটনার কয়েক মাস পর বিশ্বকে চমকে সেই আয়না সত্যি সত্যিই আবিষ্কার করে ফেললেন এক বিঞ্জানী। কিছুদিন পুলিশেরা ব্যবহার করে অপরাধ দমনে বড়সর সাফল্য পেল। পরবর্তীতে পুলিশের সর্বস্তরের কর্তারা অপরাধীদের ব্ল্যাকমেল করে বেশ কিছু মুনাফা করতে থাকল। একসময় আয়না সহজলভ্য হয়ে গেল। মধ্যবিত্ত, সাধারণ সবার ক্রয়যোগ্য হয়ে উঠল। আয়না কিনল, নিজেদের স্বরূপও চিনল কিন্তু বিশ্বাস তো করলই না উপরন্তু রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে আপন আপন দর্পণ ভেঙে চূর্ণ করল। আবিষ্কর্তা বিঞ্জানীকে সপ্তমস্তরীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হল।

অনেকের মত অনেক দোষে দুষ্ট সেই রনজিৎও একটি আয়না কিনল। নিজ সামনে দর্পণটি ধারণ করলে তাতে কিছুই প্রতিফলিত হল না। এ স্থলে আমাদের নিজেদের মধ্যে কোন দোষ ত্রুটি নেই ভেবে আহ্লাদিত হতে পারতাম কিন্তু রনজিতের চিন্তা ভাবনা বিচিত্র সে ভাবল তার দোষ ত্রুটির সংখ্যাটা এত অধিক ঐ ক্ষুদ্র দর্পণে তার প্রতিফলন সম্ভব না। অনেকটা মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে আসা 'ইউ হ্যাভ ইনসাফিসিয়েণ্ট মেমোরি'র মত। এই ঘটনার কয়েক মাস পর রনজিৎকে বেশিদিন আর দেখা যায়নি। অমিয়বাবু বয়সের ভারে জর্জরিত। তার ছেলে বাবাকে ছাড়িয়ে গিয়ে এমএলএ হয়েছে। অর্ণব মরুভূমিতে কৃত্রিম ভাবে বৃষ্টি ঘটানোর গবেষণায় নিয়োজিত। তারই সূত্র ধরে এক মরুভূমির উপর দিয়ে বিমানের যাত্রী হল সে। একদিন মরুভূমিতে এক স্থানে তাদের চোখ আটকে গেল। উপর থেকে নিচে দেখল সবুজের ছোপ। অবতরণ করে দেখল আশেপাশের অনেকটা স্থান জুড়ে গুল্ম ও কিছু বৃক্ষ জাতীয় স্বভোজী জীবে পরিপূর্ণ। জড় পদার্থ বলতে কিছু কাঁচের টুকরো ও দূইতিনটি হাড়গোর, সে গুলো কোন প্রাণীর তা নিয়ে গবেষণা চলছে ।

----------------------

Comments

Popular posts from this blog

আলী হোসেনের ছোটগল্প। এক এক্কে এক।

এক এক্কে এক : ছোট্ট বেলা নামতা পড়ার সময় এভাবেই শুরু করত মান্তু। তখন জানতো না কি এর মানে, কেনই বা পড়তে হয়। মা বলতেন, নামতা হল অঙ্কের মাথা। কিম্বা মেরুদণ্ডও বলতে পারিস। এটা ঠিকঠাক না শিখলে অঙ্ক মেলে না। যখন প্রাথমিক স্কুল ছেড়ে মাধ্যমিকে পৌছেছে, তখন মায়ের কথার মানে বুঝেছে মান্তু। কিন্তু পরিণত বয়সে এসে, আজ বুঝেছে এর অন্য মানে। এটা না জানলে, জীবনের মানেটাই পালটে যায়। মিলতে চায় না জীবনের অঙ্কটাও। মান্তু তখন ক্লাস এইটে। হঠাৎই দুঃসংবাদটা এলো। ক্লাসে সেলাই দিদিমনি, ফ্রেঞ্চনটের গীট ধরে আটকানোর চেষ্টা করছেন। বোঝাচ্ছেন, কিভাবে একে কব্জা করতে হয়। মান্তু কিছুতেই এই গিঁটকে কব্জা করতে পারছেনা। মাথার ওপর বোঁবোঁ করে ঘুরছে পাখা, অথচ ঘামের স্রোতে ভাঁটার টান নেই মোটেও। বাইরের বাতাসে উত্তাপের পারদ নিশ্চয়ই লু-লেবেল ছাড়িয়েছে। বাতাসের শুষ্ক বুকে তরঙ্গ তুলে সে ছুটে চলেছে শরীর জুড়াতে আন্য কোথাও, অন্য কোনখানে। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে চাঁদনি থেকে দোকানের মাল নিয়ে ফিরছিল ফারহাদ। হঠাৎই চরকির মত ঘুরে গেল মাথাটা। পিচ-গলা রাস্তায় আছড়ে পড়লো মস্ত শরীর। পথ-চলতি নজর চকিতে ঘুরে এল ফারহাদের দিকে। কে বলে কলকাতার হৃদয়ে উষ্ণতার অভা

শুভ্রা সাহার ছোটগল্প। লকডাউন।

গল্পকারের কন্ঠে গল্প পাঠ। গল্পের নাম : লক ডাউনের গল্প গল্পকারের কন্ঠে গল্প পাঠ। গল্পের নাম : লক ডাউন গল্পকারের কন্ঠে গল্প পাঠ। গল্পের নাম : লক ডাউনের গল্প আলোচিতা এখন আর আগের মতো বোর হয় না। ঘরে বসেই ছোট বোন সঞ্চিতাকে নিয়ে অনলাইনে গান, বন্ধুদের সঙ্গে গল্প, বিভিন্ন প্রোগ্রাম করে সময় কাটিয়ে দেয়। লকডাউন-এ পড়ে কি যে নাজেহাল অবস্থা সকলের! মাত্র কয়েকদিন আগে, দিল্লি থেকে বাড়ি ফিরেছে সে। তখন তো ওর আসার কথাই ছিল না। হঠাৎ বাবার হার্ট অ্যাটাক হওয়াতেই আসতে হলো। আলোচিতা অর্থাৎ আলো। আর সঞ্চয়িতা অর্থাৎ সঞ্চিতা। ওরা দু'বোন। বাবা বিরাজবাবু স্কুলের শিক্ষক। মা রূপালি দেবী গৃহিণী। আলো দিল্লিতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেছে গতবছর। সঞ্চিতা দ্বাদশ শ্রেণীতে। শিক্ষকতা করার সুবাদে আলোর বাবা বিরাজ বাবুর এলাকায় যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। ওদের এলাকায় হিন্দু মুসলিমের সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি। বিরাজ বাবুর অনেক মুসলিম ছাত্রও আছে, যারা প্রায়ই ওনার কাছে আসে। বিভিন্ন মতামতের জন্য। বিরাজবাবু বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন। সুনাম

সুদীপ্ত ভাস্কর দত্তের ছোটগল্প। ২০২১ : করোনার পরে।

audio testing গল্পকারের কণ্ঠে গল্প পাঠ  ২০২১ : করোনার পরে নদীর জলটা এত টলটলে, পরিষ্কার আগে দেখিনি কোনদিন! পাড়ে বসে একটা মুগ্ধতা নিয়ে স্বগতোক্তি করল অরুণ। বসন্তের আরম্ভে এই মৃদুমন্দ বাতাসটা প্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছিল।। পড়ন্ত বিকেলে নির্জন নদীর তীরে, গাছের পাতার আড়াল থেকে একটা বউ কথা কও মাঝে মাঝে ডেকে উঠছিল। করোনা মহামারী রোধের চেষ্টায় সারা পৃথিবী জুড়ে যে লক ডাউন চলেছিল, তার ফলেই প্রকৃতি এখন দূষণমুক্ত, নির্মল।