Skip to main content

উজান-কথা। আয়েশা খাতুনের ছোটগল্প।

উজান-কথা

মনের ভিতরের একটা জানালা খুলে দিয়েছে নীরালি, নামের বৃতান্ত নাইবা জানলে তোমরা শুধু এইটুকু জেনো যে তার নাম নীরালি, মেয়ে ছাড়া কাকে নিয়েই বা কবিতা আর কাকে নিয়েই বা গান গল্প বলো! বড়ো লাচার বাবো, ইঞ গালমারা ক্যা শুনবে ? ইয়া তো লিতকার গালমারা, এই তো ধর ক্যানে চয়ত মাস্যের র‍্যোদ বটে গো মাথার অপরে বারটা চাঁন্দুবুঙ্গা মাথাটকে ফাটিন্দিচ্ছে র‍্যোদে, মাটিটর অপরে ট্যাংট তো রেখায় যায় না খো, কেন্তনা সি কুন ছুটু থেকে গোগোর তি ধরে আগুনের অপরে হ্যাঁটে হ্যাঁটে পায়ের তুলাটতে তো ঘুড়ার পারা লুহার ল্যাল পিন্দে লিয়েছি, মাটিট ক্যামুন লিজের হুয়ে যেলছে দ্যাখ আপনি থেকেই। তো কুথা যাব্বোঃ কুন ব্যাগে যাব্বোঃ গো! বাবোকুড়া কুন ব্যাগে যাব্বোঃ?
অপূর্ব নরম সোনালি রোদ ঊঠেছে, রোদ্দুর তো নয় যেন ঘানি থেকে পিষে আনা সরষের তেল, পূব আকাশ এখন সারি সারি হাতির শুঁড় হয়ে আকাশ থেকে মাটিতে ছড়িয়ে দিচ্ছে সেই রুমালি রোদ দ্বারকা নদীর জলে পড়ে এক হলুসা রঙ সারা জলে জলময় হয়ে মাছেদের সঙ্গে খেলে বেড়াচ্ছে। দ্বারকা নদী অনেক ইতিহাসের সাক্ষী সাঁওতাল বিদ্রোহের সময় সাঁওতালরা দিকুদের গায়ের তাজা রক্ত নিজেদের গায়ে মেখে সে সারাব ধুয়েছিলো প্রথমবার এই নদীর জলে, সে সময় সে নদীর জল কি হাঁড়িয়া হয়েছিলো? তা না হলে কি আর মাছেরা মাতাল হতে পারে! আর আজ এ জল অন্যরূপের। সারা বছর এখন আর এই দ্বারকা নদীতে জল থাকে না এখন থাকে শধু এক নদী কাশ ফুল, মেঘেরা কোন্ অভিমানে এই এলাকা থেকে চলে গেছে, আচ্ছা মেঘ চলে গেলে কি আর গাছ পালা, সবুজ ঘাস মাথা তুলতে পারে? ও দিকে মেঘের অন্য অভিযোগ, সে বলল আচ্ছা তোমরা যে বলো, আমি চলে গেছি কিন্তু এই মরুভূমির মহাসাগরে যদি আমাকে কেউ নঙ্গর হয়ে না ধরে রাখে তাহলে আমি দাঁড়াব কি করে? অন্য নঙ্গররা তো আমাকে টেনেনেয়। বারংবার এই কথা বলার পরও যখন ইট পাথর, বালি মাটি বুঝতেই পারছে না তখন মেঘ নিজেই বলল, ওহে তাও জানো না আমাদের ধরে রাখার নঙ্গোরের নাম কি? যাকে সহজ কথায় বলা হয় গাছ। সবুজ পাতার জঙ্গল। 

ইটেরা বলল - বাজে কথা বলো না,

মেঘ, ইট পাথর দের কথা শোনে না সে বলে, না না সেসব হারিয়ে গেছে, এখন যা আছে তা দিয়ে তোমাদের বোকামির ঘর বাঁধা যায় কিন্তু তা দিয়েতো আর মেঘের নঙ্গর বাঁধা যায় না!

এই দ্বারকা নদী যেখানে তার মধ্যগতি শেষ করে নিন্ম গতিতে পড়েছে তার ঠিক এক কিলোমিটারের মধ্যে নদী বেশ প্রসস্থ আর একটু হলেও তুলনায় গভীর, এখানে কি করে যেন এক নদী জল, সারা বছর একটা নৌকা পারাপার করে, আর এই জল কাজল কালো, নদীর দুই তীরে ঘন বাঁশ জঙ্গল মাঝে মাঝে তালগাছ আর গাঢ় সবুজ জাম আর বকুলের পাতাভরা ডাল, মাছেদের অমন তেলচুঁখ শরীর মাছরাঙাদের ঠোঁটে উন্মাদনা এনে দেয়, ট্যাস্কোনা পাখিদের নোয়ানো বাঁশের ডালে বসে অপেক্ষার দোল খাওয়া, ভোর বেলা নৌকাটা বাঁধা থাকে এই নদীর ঘাটে, জল তখন স্থীর আর এই আয়নাতে নৌকাটার কোনো উল্টো সোজা বোঝা যায় না, এখানে যেন এক শিল্পী অতি যত্নে ছবি এঁকে রেখেছে, আজ এখন এই জাফরানি জলে কালো নাউ খানি একাই অবগাহন করে আছে। যেন এক ধ্যান মৌন তরুণী কন্যার নতুন আভাস ফুটে ওঠে।

দেখতে দেখতে এ রুপ বদলে যায়, চারিদিকে পাখির ঝাঁক চক্রাকারে উড়ে যায় হাল্কা বাতাসে বাঁশের পাতারা জেগে ওঠে নদীর জলে তিরতির করে ঢেউ গড়ানো চোখ মেলে, এই ফাঁকে একটা মাছ নড়ে উঠলে নীল পালকের সাজানো পাখা বড়সির মত ঝাঁপ মেরে তুলে আনে রোদ মাখা কচি মাছ ,মাছ যত নড়ে তার পাখনা থেকে জল টুপ টুপ করে পড়ে নদীর জলে আর অমনি নদীর জল ক্ষেপে ওঠে শুরু হয় তার প্রতি দিনের আক্ষেপ। এই আকাশিনদীতে বয়ে এলো এক বিকেলি নোটিশ, লিচিনপুর সমেত সারেন্ডা অধ্যুসিত ছোট ছোট টিলার অধিবাসিদের আপন আপন অভিবাস ছেড়ে চলে যেতে হবে ময়ূরাক্ষীর পূর্ব তীরে যেখানে এক প্রাণহীন গ্রাম আটাত্তরের বন্যার ভাঙা নদীর চৌমহুনির চরে গজিয়ে তুলেছে ।

এই নোটিসকে ওখানের মানুষেরা তুচ্ছ্যাতিতুচ্ছ্য করে ফেলে দিয়েছে এর আগে, কিন্তু এই বার সত্যি সত্যিই ছেড়ে চলে যেতে হবে সেই অপূর্ব দ্বারকা নদীর লিচিনি গ্রাম আর সেই মূলনিবাসিদের তাড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছে এক পুরাতনি মূল নিবাসী যুবক যার এখনকার নাম বাবু --। এই বাবুকে কয়েকটি প্রশ্ন করবে বলে ঠিক করে রেখেছে নীরালি কিন্তু সময় আর হয় না, আজ এই অতিসকালে এক নদীর বাঁকে এক ঝাঁক হাঁস ভেসে এসেছে কয়দিন হল তাদের দেখতে এসেছিলো এই নীরালি, আর এখানে এই নৌকাতে দেখা হয়ে গেলো বাবুর সঙ্গে ---, বাবু একায় নৌকা বাইছে আর নীরালি সাহস করে এই নাউটাতে উঠে বসেছে, এই তো সুযোগ বাবুকে প্রশ্ন করার। বাবুকে কিছু কথা বলতে শুরু করেছে নীরালি ------

ভাবছিস কি, দুঃখের গালমারাট কুরতে আসেছি? না না উট তো লিতকার গালমারা বটে, ইঞঃ কথাটর খানিক ফারাক আছে বৈকি। হ্যেয় গো, তুরাতো আমাদেরকে আমাদের উড়া থেকে, জুমি থেকে, বুন থেকে, ডাহার থেকে ঘুটু থেকে গাড্ডা থেকে তাড়িন দিলি, আমাদের ডাঙ্গারা আমাদের কাড্ডা, মেরম, গেডে সগুলি ক্যাড়ে লিলি, আমাদের মরদ গুলানকে তুদের উড়ার মুনিশ করে লিলি, আমাদের কাটিকাটি গিদরে গুলানকে তুদের ঘরের বাগাল করে লিলি, আমাদের প্যাটে আখুন তুদের গিদরে ভরে দিলি, কী দুঃখের গালমারা আমাদের! এই গালমারাট আখন লিতক্যের আর লয়খো, ইয়াট এক মস্তবড়ো জানুমঘূটুর পারা বহু পুরোনো কিসসা বটে। কুনু দিন আমাদের গিদরে যদি আমাদের প্যাটে ধরে জনম দিতে পারি তো তারা এই কিসসাট তালের পাতাতে, ঝাড়ের পাতাতে, জজর পাতাতে ল্যাখে র‍্যাখবে, ইঞঃ গালমারা ট তুখে শুনায়তে আসেনিখো গো বাবোকুড়া!

ত যে গালমারাট আমি শুনায়তে আসেছি সিটো বুলি তুখে, শুনেছি নাকি বিনা ছুরি-বুঠিতে দিকুদেরকে মারেছিস, তু নাকি বিনা ছুরি-বুঠিতে হড় দিকে ম্যারেছিস? বিনা রকতে সব দিকু হড় নাকি মর‍্যে যেলছে মোড়ে বছ্যোরের ল্যাগে? ওই মরাগুলা নাকি পচব্বেঃ নাখোও, খেরাপ হব্বেঃ নাখোও, লশট হব্বেঃ নাখোও? ওই মরা দিকু গুলান নাকি জ্যান্ত লাশ হুঁয়ে ঘুরে বেড়ায়ছেয়।

যে দিকু গুলান তুদের ল্যাঠ্যাল ছেলো আমাদেরই জ্যাতভাই ছেলো, হড় ছেলো তখুন, সেই হড় গুলান দিকু হুঁয়ে গ্যালো, আমাদের সব ক্যাড়েকুড়ে লিয়ে তুদের আগ্নেতে হুড়ুর তলা ব্যান্ধ্যে দিঁয়েছ্যেলো, বাবা-লো! সেকি র‍্যাগ দিকু গুলার! যদি বুলত্যাম, হারে তু ক্যামুন করে এতয়ও খুন খারাবি কুরছিস আমাদের সাঁথে? তু তো আমাদেরইপারা হড় ছিলিসর‍্যা! এ কুথাট শুনেই তাদের কি র‍্যাগ গুসা! বাব্বা-লো! চড় চাপড় ম্যারেও চুপ হতোই নাখোও, একট ঠ্যিঙ্গা দ্যাখ্যানে বলত কি, বিশি বিশি বুলবি যুদ্দি এই ঠ্যাঙ্গাটকে তুদের পোঙ্গা দিয়ে ভরে দুব্বো হ্যা হ্যা বাবাঃ।

এ সব কুথা শুনে জানের ভ্যাতরট থরথর করে বতরে ক্যাঁপে উঠত, বাবা-লো! ক্যারা দ্যাশে আলো! মরদটকে কুথা পাব্বোঃ? সি ত ক্যার উড়াতে মুনিষ হুঁয়ে পড়ে আছে? কুন শুঁড়ির মদেরসালে মাতাল হুঁয়ে ঘুমিন আছে! আমাদের ত দেব্তা নাইখোও আমাদের ত শয়তান নাই খোও আমাদের ত আর মাটি নাই খোও আমাদের তো সুন্মান নাই খো, আমাদের ত গিদরে নাই খোও, আমাদের ত নিন্দোঃ বিলা নাই খোও, আমরা তো শুয়োর গুলান মত বুটি, যতই ঠ্যিঙ্গা দিয়ে মার ক্যানে, মরবোই না, আমাদেরকে যতই তাড় ক্যানে আমরা আলামারা হবোই না, আমাদেরকে যতই মাটি ছাড়া কর ক্যানে মাটি আমাদেরকে ছাড়বেন না। আমরা যত দউড়ব আমাদের গতর থেকে ছুটু ছুটু জিলের ছেঁচড়া মাটির চ্যাঙ্গোড় হয়ে ছ্যাড়ে ছ্যাড়ে পড়ে আমাদেরই মাটি হুবে জুমি হুবে গাড্ডা হুবে, তুরা লারবি গো আমাদেরকে তাড়িন দিতয়ে।

দ্যাখ ক্যানে কথাট সত্যিই বটে কি লয়? আমাদের মতুন হড়দেরকে ম্যারতে ম্যারতে আমাদের উড়াকুড়ি কাড়তে কাড়তে যখুন তুরা দিকু হুয়ে আমাদের তাড়ছিলিস তখুন আমরা ঝ্যোড়ের পারা বাতাসে লিজেদেরকে উড়িন লিলাম পাহাড়ের পরবতের অপরে। আমরা যখুন জানুম ঘুটু, জজ ঘুটু ছ্যাড়ে, রল-কানালি ছ্যাড়ে কালো মাথামুটা মরাখোকো ডুরা গুলার পারা পাথর ধরে ধরে পাহাড়ের মাথায় উঠছিলোম তখুন তুরা দাঁড়িনে আমাদের বতর দেখেছিলিস, আমাদের ঝরে পড়া ঘাম দেখে ছিলিস আর হাসতে হাসতে মাটিতে উলঠিন উলঠিন পড়ছিলিস, আমাদের কুড়িগুলান কে তখন তুরা লিছিলিস, তাদের রোঃ-দায় দেখবার শুনবার সুময় ছিলই না, লিজের জানটকে বাঁচাবো বলে র‍্যা!

আমাদের এই দুঃখের গান দিকুদেরকে শুনাতে যায়নি কুনু দিন। উয়োরাতো দিকু, হড় লয়খো, দ্যাখ ক্যানে আমাদের দুঃখের গান শুনতে শুনতে কালোকালো পাথর গুলান তাদের গতরের পাশে ঘাস জনম দিল, মেরম, ডাঙ্গারা গুলার জনম দিলো, তাদের বুকে আমাদের বসতে দিলো, নিন্দোবিলা দিলো, তিঙ্গুতে বল দিলো, মকায় দিলো চুঁহা দিলো, মাদলের কাঠ দিলো, চামড়া দিলো, বাঁশের বাঁশি দিলো, বুকে মুন দিলো, আলাং এ লাগাম দিলো আর আমদের চোখে শরম দিলো, মাথার আগুন কাড়েলিলো মাথায় বুদ্ধি দিলো আর বলল বাইরের ধর্ম থকে দূরে ছিলিস আর দূরেই থাকিস, ইঞের ধর্ম গাছটতে দাঃ ঢালিস।

এতো কথা নীরালি বলে একটু থামল, তখন বাবুর নাও খানা উত্তর পূর্ব থেকে বেরিয়ে এসে নদীর মাঝ বরাবর ভাসছে, বাবুর কোন কান নেই, সে কি স্থির উন্মাদ --। নীরালি তার এই স্থির উন্মাদনাকে অবজ্ঞা করল, নীরালির কপালে তখন অনেক গুলো কালো ফুটকি ফুটে উঠল যা তার ভয়ের কারন নয় বরং তাকে সাহসি করে তোলে, সে পুনরায় বলতে শুরু করল, তাইতো করছিলোম, কেন্তনা এই কুথাট শুনে আমি তর কাছে আলোম-গো বাবোকুড়া এই কুথাট জানবার ল্যাগে জি তু কি মন্তর শিখেছিস বটে তুদের বুঙ্গার কাছে? যে বিনা ছুরি-বুঠিতে দিকুদেরকে মারেছিস, তু নাকি বিনা ছুরি-বুঠিতে হড় দিকে ম্যারেছিস? বিনা রকতে সব দিকু হড় নাকি মর‍্যে যেলছে, মোড়ে বছ্যোরের ল্যাগে? ওই মরাগুলা নাকি পচব্বে নাখোও, খেরাপ হব্বে নাখও, লশট হব্বে নাখোও? ওই মরা দিকু গুলান নাকি জ্যান্ত লাশ হুঁয়ে ঘুরে বেড়ায়ছেয়। নীরালি এক ধমক দিয়ে বলে - হ্যেয় গো এই মন্তরটর নাম নাকি গণ তন তর?

বাবা:-লো! ই কথাট শুনে তো আমাদের বুকের ভ্যাতরট আবার রিমিলের পারা আঁচল পাঁছল কচ্ছে গো হ্যায় দ্যাখ কেনে গো, হ্যায় কথাট শুনে ক্যামুন লান্দায় লাগছে মুনে। এই মন্তরটর নাম নাকি গণ তন তর ?

বাবুর নাও এবারে মীন ধরার জন্য তৈরি, কিন্তু এ যে দ্বারকা নদী বেশি দূর যেতে পারবে না এর ঢেউ নেই টান ও নেই শুধু এই লিচিন পুরের ঘাট কেমন করে ছবি হয়ে আছে। নীররালি বাবুর মিন ধরার উদ্যোগ দেখে ঠোঁট টান করে রইল, এই সময় সে একটু থেমে যায় কারন বাবুর মীন ধরার ব্যাঘাত ঘটলে নীরালির এখন ই কথাবলা শেষ হবে --।

নৌকা নড়ে উঠল, মাছেরা ছলবল করে নাওয়ের পাশ দিয়ে পুচ্ছ তুলে পালিয়ে গেল, দুএকটি মাছ অর্ধ বিত্তাকার লাফ দিয়ে জলের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গাতে লুকাল, বাঁশের ডালে বসে থাকা নীল পালক বাতাসে বিছিয়ে দিয়ে জলের দিকে এগিয়ে এলো রূপোলী পিঠ ছোঁ মারার জন্য – কিছু ক্ষণ টালমাটাল পরিস্থিতি, এখন সামলে নিল নদী -- এখন শান্ত আর ধীর—নীরালি কথা লীশাড়ি বলতে থাকল --,

দ্যাখ ক্যানে ত্যামউন করে কি আর বুলার আছে, আমাদের গোগোর মুখের কথাট কবে ভুলে গেলছি আখ্যুন মুখে ঝড়াম ঝড়াম করে বাংলা বেরেয়, ঝড়াম ঝড়াম করে হীনদি বেরেয়, আগে গুরু গুলান হড়কুথা বোজত আখ্যুন খুবই বাংলা বোজে, আবার বাংলা গুরু গুলান ছ মাসের কাগজের সাঁথে গালমারা করে আমাদের অলচিকিটকে হাজম করতে শিখ্যাছে আর আমাদের অলচিকিট তে নাকি বাঙলার গুরু গুলান চাকরি করছ্যে আর ঝুড়িতে ঝুড়িতে ঘ্যাঁস না খিয়ে বড্ডই টাকা খাচে? তা ই কথাট তো লান্দাবারি কথা আছে নাকি বুলতও বাবোকুড়া ?

নীরালির থামা নেই কথার শেষ নেই,এখন যেন সে এক আষাঢ় নদী। ছাপিয়ে ছাপিয়ে নদীর দু কুলকে ভিজিয়ে দিয়ে যায় ।

বাবোকুড়া এক নিঃলজ্জো মূর্তি যেন, বসে আছে নীরালিদের ঘর থেকে চুরি করে নিয়ে আসা সেই রাজ সিংহাসনে যার চারি বেড়ে পাহারা দিচ্ছে সেই হড় থেকে দিকু হয়ে যাওয়া খাঁসটে রঙের পোশাক পরা দিকুরা। 

বাবোকুড়ার হাত নিসপিস করছে নীরালিকে ধরবার জন্য, নীরালি মাটির মেয়ে তার গায়ে আছে হরিণের মাংস, যে মাংসের গন্ধ বাবোকুড়াদের মাতাল করে। বাবো কুড়ার মাঝে মাঝে ঘুম পাচ্ছিল কারন ওই হরিণের মাংস সে ক্ষণে ক্ষণে খায় আর দিকুরা যোগান দেয়। বাবোকুড়ার ঝিমুনি দেখে নীরালি খলখল করে হেসে উঠল, নীরালি এবারে প্রশ্ন তুলল। হ্যায় বাবোকুড়া আখন তো আর আমাদের উড়া-কুড়ি নাই খো কেন্তনা তুদেরতো উড়া চায় যিথা আগুন লাগাবি মুনের সুখে, তুদের তো কুড়ি চায় যাখে নিয়ে টিঙ্গা কাবি মুনে সখে, তাহলে কি তুরা সি কামট কে থামিন দিলি? এ কথা বলে নীরালি একবার তার শরীরটাতে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, তাতো হতেই পারে না – তদের তো শুয়োরের জিল যায় ই চায়। তাহলে কি এবারে দিকুদের উড়াতে আগুন দিলি আর দিকুদের কুড়ি নিয়ে ঠ্যিঙ্গা গাতি কচ্চিস? হে হে আমার তো লান্দায় পাছে, ইঞ ইবারে খানিক বুদ্ধি করতে পারছি। দিকুরা আখন নাকি কেবলই গুরু নিয়ে পদ্য ল্যাখছে, গুরুগুলানকে প্যাটে ধরছে, গুরুর জনম দিচ্ছে, দিকুর চেহে নাকি আখ্যন গুরুর চড়া বাজার? হে হে আমার তো খুব লান্দায় পাছে, বাবোকুড়া এই দিকু গুলান এক দিন হড় থেকে দিকু হুয়ে গ্যালো তুদের ডরে জান বাঁচাতে। বাবোকুড়া দিকুদের একবার শুধা ক্যানে, যে জান বাঁচাতে তারা একদিন হড় থেকে দিকু হুয়ে ছ্যালো আজ কি জান বাঁচাতে দিকু থেকে ডাংরা হয়ে যাবে ?
-------------------------------

ফুটনট- 

হড় ভাষার শব্দ গুলোর মানে (ইঞ – আমার, গালমারা- আলোচনা, চাঁন্দুবুঙ্গা- চাঁদ ও সূর্য দেবতা, গোগোর – মায়ের, তি- হাত, উড়া-ঘর, ডাহার-রাস্তা, ঘুটু-ছোট টিলা অথবা পাহাড়, গাড্ডা – নদী, ডাঙ্গারা – গরু, কাড্ডা- মহিষ, মেরম-ছাগল, গেডে-হাঁস, কাটিকাটি- ছোট ছোট, গিদরে- বাচ্চা ছেলে, জানুমঘূটুর- কুলেরপাহাড়, ঝাড়ের – গাছের, জজো-তেঁতুল, দিকু- বাঙালী, হড়-মানুষ (আদিবাসী মানুষ ), মোড়ে- পাঁচ, হুড়ুর- ধানের, ঠ্যিঙ্গা- লাঠি, বতরে- ভয়ে, উড়াকুড়ি – ঘর কন্যা, নিন্দোবিলা- রাত বা ঘুমের সময়, রোঃ-দায়- চোখের জল বা কান্না, তিঙ্গুতে-পায়ে, চুহা- ইঁদুর, দাঃ- জল, বুঙ্গা- দেবতা, রিমিলের- মেঘের, লান্দায়- হাসছে, গুরু- গরু, ডাংরা – গরু, অলচিকিট- সাঁওতালি অক্ষর, জিল-মাংস, গাতি- খেলা, লিশাড়ি – বিরামহীন এটা আঞ্চলিক বাংলা শব্দ )।

Comments

Popular posts from this blog

আলী হোসেনের ছোটগল্প। এক এক্কে এক।

এক এক্কে এক : ছোট্ট বেলা নামতা পড়ার সময় এভাবেই শুরু করত মান্তু। তখন জানতো না কি এর মানে, কেনই বা পড়তে হয়। মা বলতেন, নামতা হল অঙ্কের মাথা। কিম্বা মেরুদণ্ডও বলতে পারিস। এটা ঠিকঠাক না শিখলে অঙ্ক মেলে না। যখন প্রাথমিক স্কুল ছেড়ে মাধ্যমিকে পৌছেছে, তখন মায়ের কথার মানে বুঝেছে মান্তু। কিন্তু পরিণত বয়সে এসে, আজ বুঝেছে এর অন্য মানে। এটা না জানলে, জীবনের মানেটাই পালটে যায়। মিলতে চায় না জীবনের অঙ্কটাও। মান্তু তখন ক্লাস এইটে। হঠাৎই দুঃসংবাদটা এলো। ক্লাসে সেলাই দিদিমনি, ফ্রেঞ্চনটের গীট ধরে আটকানোর চেষ্টা করছেন। বোঝাচ্ছেন, কিভাবে একে কব্জা করতে হয়। মান্তু কিছুতেই এই গিঁটকে কব্জা করতে পারছেনা। মাথার ওপর বোঁবোঁ করে ঘুরছে পাখা, অথচ ঘামের স্রোতে ভাঁটার টান নেই মোটেও। বাইরের বাতাসে উত্তাপের পারদ নিশ্চয়ই লু-লেবেল ছাড়িয়েছে। বাতাসের শুষ্ক বুকে তরঙ্গ তুলে সে ছুটে চলেছে শরীর জুড়াতে আন্য কোথাও, অন্য কোনখানে। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে চাঁদনি থেকে দোকানের মাল নিয়ে ফিরছিল ফারহাদ। হঠাৎই চরকির মত ঘুরে গেল মাথাটা। পিচ-গলা রাস্তায় আছড়ে পড়লো মস্ত শরীর। পথ-চলতি নজর চকিতে ঘুরে এল ফারহাদের দিকে। কে বলে কলকাতার হৃদয়ে উষ্ণতার অভা

শুভ্রা সাহার ছোটগল্প। লকডাউন।

গল্পকারের কন্ঠে গল্প পাঠ। গল্পের নাম : লক ডাউনের গল্প গল্পকারের কন্ঠে গল্প পাঠ। গল্পের নাম : লক ডাউন গল্পকারের কন্ঠে গল্প পাঠ। গল্পের নাম : লক ডাউনের গল্প আলোচিতা এখন আর আগের মতো বোর হয় না। ঘরে বসেই ছোট বোন সঞ্চিতাকে নিয়ে অনলাইনে গান, বন্ধুদের সঙ্গে গল্প, বিভিন্ন প্রোগ্রাম করে সময় কাটিয়ে দেয়। লকডাউন-এ পড়ে কি যে নাজেহাল অবস্থা সকলের! মাত্র কয়েকদিন আগে, দিল্লি থেকে বাড়ি ফিরেছে সে। তখন তো ওর আসার কথাই ছিল না। হঠাৎ বাবার হার্ট অ্যাটাক হওয়াতেই আসতে হলো। আলোচিতা অর্থাৎ আলো। আর সঞ্চয়িতা অর্থাৎ সঞ্চিতা। ওরা দু'বোন। বাবা বিরাজবাবু স্কুলের শিক্ষক। মা রূপালি দেবী গৃহিণী। আলো দিল্লিতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেছে গতবছর। সঞ্চিতা দ্বাদশ শ্রেণীতে। শিক্ষকতা করার সুবাদে আলোর বাবা বিরাজ বাবুর এলাকায় যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। ওদের এলাকায় হিন্দু মুসলিমের সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি। বিরাজ বাবুর অনেক মুসলিম ছাত্রও আছে, যারা প্রায়ই ওনার কাছে আসে। বিভিন্ন মতামতের জন্য। বিরাজবাবু বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন। সুনাম

সুদীপ্ত ভাস্কর দত্তের ছোটগল্প। ২০২১ : করোনার পরে।

audio testing গল্পকারের কণ্ঠে গল্প পাঠ  ২০২১ : করোনার পরে নদীর জলটা এত টলটলে, পরিষ্কার আগে দেখিনি কোনদিন! পাড়ে বসে একটা মুগ্ধতা নিয়ে স্বগতোক্তি করল অরুণ। বসন্তের আরম্ভে এই মৃদুমন্দ বাতাসটা প্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছিল।। পড়ন্ত বিকেলে নির্জন নদীর তীরে, গাছের পাতার আড়াল থেকে একটা বউ কথা কও মাঝে মাঝে ডেকে উঠছিল। করোনা মহামারী রোধের চেষ্টায় সারা পৃথিবী জুড়ে যে লক ডাউন চলেছিল, তার ফলেই প্রকৃতি এখন দূষণমুক্ত, নির্মল।