Skip to main content

শুভ্রা সাহার ছোটগল্প। লকডাউন।

গল্পকারের কন্ঠে গল্প পাঠ। গল্পের নাম : লক ডাউনের গল্প গল্পকারের কন্ঠে গল্প পাঠ। গল্পের নাম : লক ডাউন

গল্পকারের কন্ঠে গল্প পাঠ। গল্পের নাম : লক ডাউনের গল্প

আলোচিতা এখন আর আগের মতো বোর হয় না। ঘরে বসেই ছোট বোন সঞ্চিতাকে নিয়ে অনলাইনে গান, বন্ধুদের সঙ্গে গল্প, বিভিন্ন প্রোগ্রাম করে সময় কাটিয়ে দেয়। লকডাউন-এ পড়ে কি যে নাজেহাল অবস্থা সকলের! মাত্র কয়েকদিন আগে, দিল্লি থেকে বাড়ি ফিরেছে সে। তখন তো ওর আসার কথাই ছিল না। হঠাৎ বাবার হার্ট অ্যাটাক হওয়াতেই আসতে হলো। আলোচিতা অর্থাৎ আলো। আর সঞ্চয়িতা অর্থাৎ সঞ্চিতা। ওরা দু'বোন। বাবা বিরাজবাবু স্কুলের শিক্ষক। মা রূপালি দেবী গৃহিণী। আলো দিল্লিতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেছে গতবছর। সঞ্চিতা দ্বাদশ শ্রেণীতে। শিক্ষকতা করার সুবাদে আলোর বাবা বিরাজ বাবুর এলাকায় যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। ওদের এলাকায় হিন্দু মুসলিমের সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি। বিরাজ বাবুর অনেক মুসলিম ছাত্রও আছে, যারা প্রায়ই ওনার কাছে আসে। বিভিন্ন মতামতের জন্য। বিরাজবাবু বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন। সুনাম ও সম্মানের জন্য বড় বড় ধনী মানুষেরাও ওঁকে সমীহ করে।

বাবার আদর্শে অনুপ্রাণিত দুই মেয়েও যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে লেখাপড়া ও সংগীতচর্চা চালিয়ে যাচ্ছে। এলাকায় ভদ্র ও বিনয়ী হিসাবে ওদের সুনাম আছে। বিশ্বে করোনা ভাইরাসের সংক্রামক অবস্থা বিরাজবাবুকে ব্যথিত করে তোলে। এই স্পর্শকাতর রোগটির প্রকোপে বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, প্রাণ হারাচ্ছেন। সরকার লকডাউন ঘোষণা করেছে। এই সময় বিরাজ বাবুর হার্ট অ্যাটাক হলেও সেটা খুব বেশি মারাত্মক ছিল না। কয়েকদিনের মধ্যেই হাসপাতাল থেকে তাঁকে ছেড়ে দেয়। এদিকে বড় মেয়ে আলো বাবার অসুখ শুনে চলে আসে। তবে মনে মনে খুব্ধ হলেও লকডাউনে মেয়েকে কাছে পেয়ে বেশ আশ্বস্ত বোধ করেন তিনি।

দিন দিন লকডাউন-এর সময়সীমা বেড়েই চলছে। করোণা সংক্ৰমণ থেকে মানুষ যাতে বাঁচতে পারে তার জন্য সরকার লকডাউনের দিন বাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চারিদিকে হাহাকার। খাদ্য নেই, চিকিৎসার সুযোগ নেই। খেটে খাওয়া মানুষের অবস্থা অত্যন্ত ভয়ংকর। এর মধ্যে যারা পরিযায়ী শ্রমিক, আটকে পড়েছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। তাদের অবস্থা আরো করুণ। যার যার সাধ্যমত খাবার-দাবার বিলি করছে। সরকার থেকেও দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন সামাজিক সংস্থাও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল।

বিরাজ বাবু এসব খবর শুনে যেন মুষড়ে পড়েন। তিনি ঘরে বসে কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্রের সঙ্গে কথা বলেন। কীভাবে নিজেদের পাড়ার এবং আশপাশের বস্তির গরিব মানুষজনকে একটু সহায়তা করা যায়। তাদের ঘরে ঘরে যাতে কিছু ত্রাণ তুলে দিতে পারেন, সে ব্যাপারে সকলকে এগিয়ে আসতে বলেন। এদেরই একজন নীরজ। ব্যাঙ্ক কর্মী। আলোকে খুব পছন্দ করে সে। কিন্তু মুখে কিছু বলেনি আজও। সে সবার আগে এগিয়ে আসে। সঙ্গে আরো দুজন বন্ধুকে নেয়। বিরাজবাবু আলোকে বলে , যা তো মা, এটিএম থেকে দশ হাজার টাকা তুলে নিয়ে আয় তো।
দশ হাজার টাকা! এত টাকা কী হবে বাবা !
গরিব মানুষগুলোর জন্য কিছু একটা করতে হবে। ওরা না খেয়ে আছে। দেখছিস না ! ও-ই নিচে মাদ্রাসার সামনে বাচ্চাগুলো কেমন উদাস ভাবে বসে আছে ! হয়তো ওদের কারো কারো পেটে একটা দানাও পড়েনি। কারণ ওদের বাবারা কেউ কেউ রিক্সা চালায়, কেউবা ঠেলা চালায়, কেউ ফুটপাতে দোকান দিয়ে বসে। এখন ওদের সবার কাজ নেই। রোজগারের পথ বন্ধ। ওদের মুখে কিছু খাবার তুলে দিতে না পারলে .............।

আলো তেতলার জানালা দিয়ে মুখ বাড়ায়। দেখে, বাবা ঠিকই বলছে। ছেলেমেয়েগুলো না খেতে পেয়ে কেমন যেন শুকিয়ে গেছে। চোখ-মুখে হতাশার কালো ছাপ। কারো পরনে আস্ত জামাকাপড় নেই। পুলিশ হয়তো এদিকটায এখনো আসেনি। তাই তাড়িয়ে দেয় নি। আলো-বাতাস হীন ছোট ছোট খুপরি ঘর থেকে এখানে বেরিয়ে এসে, ওরা যেন কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিচ্ছে। আলোর মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেল । ও বাবাকে বললো -- বাবা, তুমি অসুস্থ শরীর নিয়ে ওদেরকে খাবার দিতে যাবে কী করে? আমি নাহয় এটিএম থেকে টাকাটা তুলে আনলাম ।
আমি এখন অনেকটা সুস্থ আছি। তাছাড়া আমার ছাত্র নীরজ, তুই তো ওকে চিনিস, ও আসবে । আর ওর সঙ্গে আরো দুজন আসবে। ওরাই সব করবে। তাছাড়া আমি এখন অনেকটা সুস্থ হয়ে গেছি। এই সামান্য কাজ করলে তেমন কিছু ক্ষতি হবে না আমার।

আলো নীরজের আসার কথা শুনে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। কারণ ও জানে, নীরজ ওকে খুব পছন্দ করে। যদিও মুখ খুলে কিছু বলতে সাহস করেনি আজও। আর বললেও আলো কিছু মনে করবেনা। আলোও চায়, নীরজই আগে বলুক ওর মনের কথাটা। কিন্তু নীরজ যে এত লাজুক কেন আলো তা বুঝে উঠতে পারে না। প্রথম যখন দিল্লিতে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হতে যায়, বাবার সঙ্গে, তখন নীরজ ওদের সঙ্গেই ছিল। রেল স্টেশন পর্যন্ত ওদের পৌঁছে দিয়ে এসেছে। তখনও নীরজ বারবার আলোকে দেখছিল। যখনই আলোর চোখাচোখি হচ্ছিল, তখনই ও অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল। আলোর ভীষণ হাসি পাচ্ছিল এসব দেখে। একদম মেয়েদের মত লাজুকলতা । তারপর যতবারই আলো ছুটিতে বাড়িতে এসেছে, নীরজ যেন কোথা থেকে খবর পেয়ে যায়। বাবার সঙ্গে দেখা করার অছিলায় চলে আসে। ভাবখানা এই, যেন আমাকে চিনতেই পারে না ও !

আলো জানে, বাবাকে খুব শ্রদ্ধা করে বলেই যে নীরজ দেখা করতে আসে বার বার, এমনটা পুরোপুরি ঠিক না। হাঁদারাম! আমি, এই আলো, কিছুই যেন বুঝি না! আর উনি খুব চালাক! কলুর বলদ কোথাকার ! ব্যাংকে চাকরি করতে করতে আরো যেন কেমন দাম্ভিক হয়ে গেছে! কেন বাবা, ডুবে ডুবে জল খেতে পারিস, আর প্রেম করার কথাটা মুখ ফুটে বলতে পারিস না? একটা চিঠি লিখে, ঢিল মেরে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। আমিও ফ্রি হয়ে যাই। কিছু বলতে পারি। কিংবা আমার ফোন নাম্বারটা চাইলেও তো হয়। না, তা করবে কেন? শুধু ঘরে বসে পর্দার ফাঁক খুঁজে বেড়াবেন। এবার আসুক, আমি আর চা নিয়ে যাচ্ছি না! মা বা সঞ্চিতাকে পাঠাবো। মজা দেখাব এবার! বাবার অসুখের সময় উনি নাকি এখানে ছিলেনই না। তাই দেখা করতে পারেননি। কি জানি, কতটা ঠিক!

পরদিন সকালে নীরজ বিরাজ বাবুর সঙ্গে দেখা করতে আসে। আলোই দরজা খুলে দেয় । নীরজ আলোকে দেখে মাথা নিচু করে। প্রথমে আলোই কথা বলে - আসুন, বাবা ঘরেই আছেন। একটু হেয়ালি করে বলে, ভয় পাচ্ছেন নাকি ?
ভয় পাবো কেন ?
না, মাথা নিচু করে আছেন তো.......তাই ভাবছিলাম।......
না-না সে কিছু নয়। তা তুমি কবে এলে, জানতাম না তো !
আলো মনে মনে বলে, জানো তো খুব ভালোই। এখন নেকামি করা হচ্ছে। হাসি মাখা ঠোঁটে বলে, কেন, জানলে আসতেন না বুঝি ?"
নীরজ অপ্রস্তুত হয়ে যায়। না-না, তা কেন ! এমনিতেই বলছি। তা কবে এলে ?
বেশ কয়েকদিন হল। বাবা যখন হাসপাতালে ছিল, তখন এসেছি।
নীরজ কী বলবে ভেবে পায় না। কারণ, বিরাজ বাবুর অসুখের সময় ও বিশেষ কাজে বাইরে থাকায় হাসপাতালে যেতে পারেনি। আলো বলে, ঘরে আসুন।
নীরজ ঘরে গিয়ে বসে। বিরাজবাবু নীরজকে দেখে খুশি হন। বলেন, তোমাদের কদ্দূর? নীরজ বলে, সব ঠিক হয়ে গেছে স্যার ।

বিণায়ক আর অতনু, ওরা চাল-ডাল, তরকারি কিনে প্যাকেট করে নিয়েছে। প্রথমে মসজিদের পাশের বস্তিতে দেওয়া হবে। এখন আপনার যাওয়ার অপেক্ষায়। বিরাজবাবু বললেন, ঠিক আছে, চলো আমি যাচ্ছি।
বাবা, আমিও যাচ্ছি তোমাদের সঙ্গে। দাঁড়াও মাস্কগুলি নিয়ে আসি। ঘরে ঢোকে আলো।
নীরজ যেন চমকে উঠে, আলো যাবে! ওর বুকের বাঁ পাশটা যেন একটু টনটন করে ওঠে। একটু ভয়ও পায়। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে মনে এত ভাবনা কি ঠিক? যদি ওকে আলো এক মুহূর্তে রিজেক্ট করে দেয়? তবে নীরজ, তোমার তো আর মান-সম্মান বলে কিছু থাকবে না। ধুর কি যে ভাবছি সব আবোল-তাবোল! কোথায় আলো, ইঞ্জিনিয়ার মেয়ে আর কোথায় নীরজ, ব্যাংক অফিসার। লোকে কি বলবে? বলবে, বিরাজবাবুকে ধোঁকা দিয়ে ওঁনার সুন্দরী মেয়েকে বাগিয়ে নিয়েছে। না নীরজ, তুমি মুখে আঙ্গুল দাও। বুকে হাত দাও। এসব নিয়ে আর ভাববে না।

আলো তৈরি হয়ে এসে পড়েছে। নীরজের চিন্তায় ছেদ পড়ে। আলো বিরাজবাবুকে একটি মাস্ক দেয়। সে নিজেও পরে নেয় একটি। আলো বলে, বাবা, মাস্কটা তাড়াতাড়ি পরে নিয়ে চলো। তোমার আবার ঔষধ খাওয়ার সময় হয়ে যাবে। রূপালিদেবী বারবার আলোকে সাবধান করে দেয়, যাতে ওর বাবার প্রতি খেয়াল রাখে। নীরজকেও বলে, দেখ নীরজ, তোমার স্যারের শরীরটা এখনো পুরোপুরি সারেনি। বেশি দেরি করো না তোমরা। ওনাকে একটু দূরে দূরে রেখো। তোমরাও দূরে থেকেই প্যাকেটগুলি দিও। নীরজ আশস্ত করে, কাকিমা আপনি এক দম চিন্তা করবেন না। আমরা সব কাজ ডিসটেন্স বজায় রেখেই করব।

পরপর কয়েক দিন ওরা বিরাজবাবুকে নিয়ে ত্রাণ বিলি করে, ওদের এলাকার দরিদ্র জনগণের মধ্যে। নীরজও খুব উৎসাহি ছিল এ ব্যাপারে । মাঝে দু'দিন বিরাজ বাবুর শরীর একটু খারাপ থাকায় যেতে পারেননি। তখন আলো আর নীরজই ত্রাণের কাজ এগিয়ে নিয়ে যায়। এই ক'দিনে ওরা কিভাবে যেন অনেকটাই নিজেদের কাছাকাছি এসে গেছে। কেউ টেরও পায়নি। এর পর প্রায় প্রতিদিন অনেক রাত অব্দি ওদের ফোনে কথাবার্তা চলে।

এর মধ্যে করোণার প্রকোপ আরও বেড়ে য়ায়। ওরা ত্রাণ কাজে যাওয়া আপাতত বন্ধ করে দিয়েছে। কোথাও কোথাও গোষ্ঠী সংক্ৰমণও শুরু হতে হয়েছে ।

সঞ্চিতার বন্ধু কাদের সঞ্চিতাকে ফোন করে জানায় ওদের এলাকায় কোভিড ১৯-এ অনেকেই আক্রান্ত হয়েছে। অনেকে কোয়ারেনটাইনে রয়েছে । যত দিন যাচ্ছে, সংক্ৰমণ বেড়েই চলেছে। কাদের সঞ্চিতার গানের ক্লাসের বন্ধু। কলেজে পড়ে। বিভিন্ন জায়গায় গানের প্রোগ্রাম করে। গানের গলা ওর খুব সুন্দর। সে-কারণে গুরুজি অন্যদের থেকে ওকে একটু আলাদা চোখে দেখেন। গানের বিষয়ে কোনো অসুবিধা হলে সঞ্চিতা কাদেরের কাছ থেকেই জেনে নেয়। চট্ করে গুরুজীর কাছে যায় না। কাদেরও খুব অমায়িক ছেলে। কাউকে না বলে না। সঞ্চিতা বলে, কাদের ভাই, তোমরা সাবধানে থেকো। কাদের মাথা নাড়ে, 'আমরা ঠিক আছি। এখন আর স্যারকে বের হতে দিও না'। যদিও কাদের বিরাজ বাবুর ছাত্র নয়, তবুও ওঁনাকে স্যার বলেই ডাকে। দু-একবার ওদের বাড়ীতেও এসেছে। এখন কাদেরদের গলিটা রেড জোনে।

এদিকে বিরাজ বাবুর সর্দি কাশি দেখা দেয়। খানিকটা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে সবাই । করোনা রোগীদের সর্দি কাশি হয়, তাই খবরটি জানাজানি হতেই প্রতিবেশীরা ভয় পেয়ে যায়। তবে আলো আশ্বাস দেয়, ভয়ের কিছু নেই। কারণ গায়ে এখনো কোন জ্বর নেই। কাজেই করোনাৱ ভয় নেই। হয়তো একটু ঠান্ডা লেগেছে, তাই সর্দি কাশি হয়েছে। নিয়ম করে গরম জল ও গরম দুধ খাওয়া, গরম জলের ভাপ নেওয়া - এগুলি চলতে থাকে। কিছুদিনের মধ্যে সুস্থও হয়ে ওঠেন বিরাজবাবু।

এরমধ্যে একদিন একটু হাঁটতে বের হন বিরাজ বাবু। অনেক দিন ঘর-বন্দী থেকে একটু যেন ঝিমিয়ে পড়েছেন। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে হঠাৎ গড়িয়ে পড়ে যান। আলো, সঞ্চিতা আর রূপালি দেবী দৌঁড়ে নেমে আসেন। দেখেন বিরাজবাবু জ্ঞান হারিয়েছেন । কান- নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। বাড়ির সবাই চিৎকার করে ওঠে। কিন্তু ওদের চিৎকার শুনে আশেপাশের কেউ এগিয়ে আসেনি। একেতো লকডাউন। সবাই ঘরে দরজা বন্ধ করে আছে। কেউ কেউ জানলা দিয়ে উঁকি মেরে আবার বন্ধ করে দিচ্ছে। অথচ একদিন এরাই কত আপনজন ছিল। সুখ-দুঃখের সাথি ছিল। আজ এক মুহূর্তে সবাই যেন পর হয়ে গেল। আলো দিশেহারা হয়ে যায়। কী করবে ভেবে পায়না। সবাই হয়তো ভাবছে বিরাজ বাবুর করোনা হয়েছে। কিন্তু এক্ষুনি বিরাজবাবুকে হসপিটালে না নিয়ে গেলে বাঁচানো যাবে না। এই পরিস্থিতে নীরজের কথাই মনে আসে সর্বাগ্রে। আলো ফোন করে। নীরজ একরাশ উদ্বেগ নিয়ে ফোনের ওপার থেকে জানতে চায় -- এত সকালে ফোন করলে? তোমরা সবাই ঠিক আছে তো? স্যারের সর্দি কাশি কমেছে? জ্বর আসেনি তো ?
নীরজ তুমি শিগগির চলে এসো। বাবা পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে। এক্ষুনি বাবাকে হসপিটালে নিতে হবে। আমরা একা পারছিনা।
ওপাশ থেকে কোন শব্দ আসে না। আলো খেয়াল করেনি, কখন যেন ফোনটা কেটে গেছে। সে অস্থির হয়ে অনর্গল কথা বলতে থাকে। পরে বুঝতে পারে, হয়তো নীরজ সব কথা শোনে নি। তাই আবারও ফোন করে। দেখে ফোনের সুইচ অফ। আলো ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। রুপালি দেবী হতভম্ব হয়ে যান। কী করবে, বুঝে উঠতে পারছে না। শেষ-মেস বিরাজবাবুকে টেনে তুলতে চেষ্টা করেন। কিন্তু ভারি দেহটাকে একচুলও নাড়াতে পারলেন না। সঞ্চিতা বলে – কি হলো দিদি , নীরজদা আসছেন তো ?
ওর ফোনের সুইচ অফ ।
সঞ্চিতা বলে – দে, ফোনটা আমাকে দে, আমি করি ।
না, আর ওকে ফোন করবি না ।
আমি ফোন করলে আসবে। সঞ্চিতা দিদিকে আশ্বস্ত করে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই এম্বুলেন্স এসে হাজির হয়। তারপর সোজা হাসপাতাল। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলোনা। হাসপাতালের ডাক্তাররা বিরাজবাবুকে মৃত ঘোষণা করেন। স্বাস্থ্য বিভাগের নিয়ম অনুযায়ী করোনা টেস্ট করা হয়। হাসপাতাল থেকেই বিরাজবাবুকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া নিদান দেয় স্বাস্থ্য দফতর। কিন্তু মুখাগ্নি করবে কে? সঙ্গে কোন পুরুষ মানুষও নেই । সঞ্চিতা বললো, তুই-ই কর। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো দূরে নিষ্পলকভাবে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছেলে। সঞ্চিতার একটামাত্র কথায়, যে মুহূর্তেই এম্বুলেন্স নিয়ে হাজির হয়েছিল।

দাহ শেষে রুপালি দেবী জিজ্ঞাসা করলেন, কি নাম তোমার বাবা? তোমায় দেখে, আমার মনে হচ্ছে, পরম আত্মীয় তুমি আমাদের।
কাদের ..........পদবি বলতে যাচ্ছিল।
সঞ্চিতা মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে মায়ের দিকে তাকায়। বলে, কাদের মোল্লা। আমার গানের ক্লাসের বন্ধু। তোমার ভাষায় বিধর্মীর ছেলে।
কাদেরের নাম শুনে রুপালি দেবী ওর মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। যেন বাক শূন্য হয়ে গেছেন। শেষ পর্যন্ত এত আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, ছাত্রছাত্রী থাকতেও এই বিধর্মীর ছেলের আগুন নিতে হলো ওঁর ? হায় ভগবান!

শশ্বান থেকে ফেরার পথে আলো নীরজের ফোন নাম্বারটা ব্লক করে। আর সঞ্চিতার চোখেমুখে ফুটে ওঠে এক অদ্ভুত ভালোলাগা। কাদেরের জন্য। কাদেরও তৃপ্তি পায় এই ভেবে, অসময়ে বন্ধুর পাশে থাকতে পারাটা দরকারি, যা সে করতে পেরেছে। আচ্ছা, এই ভালোলাগা ও তৃপ্তির মধ্যে যে সম্পর্ক তার ভিত্তি কী? ধরনটাই বা কেমন? সঞ্চিতা কিংবা কাদের - দুজনার কেউ জানে না। এখনও, যখন বিরাজবাবুর করোনা টেষ্টের রিপোর্ট এসেছে নেগেটিভ।
----------------//--------------------

Comments

Popular posts from this blog

আলী হোসেনের ছোটগল্প। এক এক্কে এক।

এক এক্কে এক : ছোট্ট বেলা নামতা পড়ার সময় এভাবেই শুরু করত মান্তু। তখন জানতো না কি এর মানে, কেনই বা পড়তে হয়। মা বলতেন, নামতা হল অঙ্কের মাথা। কিম্বা মেরুদণ্ডও বলতে পারিস। এটা ঠিকঠাক না শিখলে অঙ্ক মেলে না। যখন প্রাথমিক স্কুল ছেড়ে মাধ্যমিকে পৌছেছে, তখন মায়ের কথার মানে বুঝেছে মান্তু। কিন্তু পরিণত বয়সে এসে, আজ বুঝেছে এর অন্য মানে। এটা না জানলে, জীবনের মানেটাই পালটে যায়। মিলতে চায় না জীবনের অঙ্কটাও। মান্তু তখন ক্লাস এইটে। হঠাৎই দুঃসংবাদটা এলো। ক্লাসে সেলাই দিদিমনি, ফ্রেঞ্চনটের গীট ধরে আটকানোর চেষ্টা করছেন। বোঝাচ্ছেন, কিভাবে একে কব্জা করতে হয়। মান্তু কিছুতেই এই গিঁটকে কব্জা করতে পারছেনা। মাথার ওপর বোঁবোঁ করে ঘুরছে পাখা, অথচ ঘামের স্রোতে ভাঁটার টান নেই মোটেও। বাইরের বাতাসে উত্তাপের পারদ নিশ্চয়ই লু-লেবেল ছাড়িয়েছে। বাতাসের শুষ্ক বুকে তরঙ্গ তুলে সে ছুটে চলেছে শরীর জুড়াতে আন্য কোথাও, অন্য কোনখানে। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে চাঁদনি থেকে দোকানের মাল নিয়ে ফিরছিল ফারহাদ। হঠাৎই চরকির মত ঘুরে গেল মাথাটা। পিচ-গলা রাস্তায় আছড়ে পড়লো মস্ত শরীর। পথ-চলতি নজর চকিতে ঘুরে এল ফারহাদের দিকে। কে বলে কলকাতার হৃদয়ে উষ্ণতার অভা

সুদীপ্ত ভাস্কর দত্তের ছোটগল্প। ২০২১ : করোনার পরে।

audio testing গল্পকারের কণ্ঠে গল্প পাঠ  ২০২১ : করোনার পরে নদীর জলটা এত টলটলে, পরিষ্কার আগে দেখিনি কোনদিন! পাড়ে বসে একটা মুগ্ধতা নিয়ে স্বগতোক্তি করল অরুণ। বসন্তের আরম্ভে এই মৃদুমন্দ বাতাসটা প্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছিল।। পড়ন্ত বিকেলে নির্জন নদীর তীরে, গাছের পাতার আড়াল থেকে একটা বউ কথা কও মাঝে মাঝে ডেকে উঠছিল। করোনা মহামারী রোধের চেষ্টায় সারা পৃথিবী জুড়ে যে লক ডাউন চলেছিল, তার ফলেই প্রকৃতি এখন দূষণমুক্ত, নির্মল।