Skip to main content

নীহার চক্রবর্তীর গল্প । সুধাকরী।

সুধাকরী

অনেক রাতে কে একজন কবরস্থানের দিকে  যায়। দূর থেকে মনে হয়, কোন মহিলা হবে। কিন্তু কে? কে সে? এ নিয়ে দুবরাজপুরে শোরগোল পড়ে গেলো খুব। সবার আগ্রহ তাকে ধরার। কেউ-কেউ আবার ভয়ে-ভয়ে বলে, জিন-পরী হতে পারে। অতএব এর মধ্যে যাওয়া ঠিক হবে না।

কিন্তু গ্রামের বেশীরভাগ মানুষ নাছোড়বান্দা। তাদের বোঝা চাই ব্যাপারটা কী। কিন্তু বড় ভয় বড় বালাই। এভাবে মাস খানেক গেলো। প্রায় প্রতি রাতে ওই মহিলা কবরস্থানে আসে। আবার মিলিয়ে যেতেও বেশী সময় নেয় না। গ্রামের অনেকেই দেখেছে। ভয় পেয়ে কেউ-কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে মাঝে মাঝে। শেষে এক পীরের দরগায় গিয়ে মানত করে সুস্থ হয়।

কিন্তু কে ও? আগে তো দেখা যায়নি কখনো । গ্রামের সমূহ ক্ষতি করার মতলব নিয়ে এলো কি ? এসব ভেবে গ্রামের তরুণ আর প্রবীণদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে গেলো। মেয়েরা তো ভয় পেয়ে ঘরের কোণে সেঁধিয়ে থাকে।

তবে? এবার কী হবে ?

এক মধ্য-রাতে ছুটে এলো মরহুম সুলতানউদ্দিনের ছেলে আশরাফ। ছুটে এলো গ্রামের কিছু প্রবীণ মানুষের কাছে। খুব ভয়ে পেয়ে তাদের বলল, আম্মাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সেই বিকাল থেকে। মাঝেমাঝেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। একটু রাত হলেই ফিরে আসে। কিন্তু আজ কি হল বুঝতে পারছি না। তারা শুনে থম মেরে বসে থাকলো কিছুক্ষণ। কি বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। অবশেষে ফকির মোল্লা বলল, যাওয়া যাক ওই কবরস্থানে। কপালে থাকলে আজ নিশ্চয়ই কিছু বোঝা যাবে।

তার কথা শুনে আর দেরী করলো না কেউ। রাতের অন্ধকারে একটা হ্যারিকেন নিয়ে সদলে কবরস্থানের দিকে রওনা দিলো। কবরস্থানের বাইরে থেকে কেউ কিছু দেখতে পেলো না। হতাশ হয়ে ফিরে আসার মনস্থ করলো কেউ-কেউ। কিন্তু ফকির মোল্লা নাছোড় বান্দা। সহজে ছাড়ার পাত্র নয়। সে আবার মরহুম সুলতানউদ্দিনের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল। সে বলিষ্ঠ-গলায় সবার উদ্দেশ্যে বলল, ভেতরে যাওয়া যাক। ভয়ের কিছু নেই। এখানে যারা আছে, তারা কোন-না-কোনোভাবে আমাদের আত্মীয়। তাই ক্ষতির ভয় নেই।

তার কথায় সাহস পেয়ে আশরাফকে সামনে রেখে কবরস্থানের মধ্যে ঢুকে গেলো সবাই। ফকির মোল্লা ভেতরে গিয়ে আশরাফকে বলল, বয়স হয়েছে । তাই মনে রাখতে পারি না। তোর আব্বার কবর কোনটা বল দেখি আমাকে। আব্বার কবর সে ভালোই চেনে। হ্যারিকেনের মিনমিনে আলো হাতে নিয়ে ও আব্বার কবরের দিকে এগিয়ে গেলো।


কাছে এসেই সবাই চমকে উঠলো সে। কবরের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছে কে? মহিলা মনে হচ্ছে তো! ফকির মোল্লা বেশ সাহসী। আশরাফকে বলল, তুই চুপ থাক। আমি দেখছি ব্যাপারটা। বলেই সে মুখ থুবড়ে পড়া মানুষটার গায়ে হাত দিলো।

তারপরে যা সবাই দেখল, মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো। মরহুম সুলতানউদ্দিনের বেওয়া স্ত্রী নিমেষে চিত হয়ে গেলো। সবিস্ময়ে সবাই দেখল তার দু’গাল বেয়ে কান্নার শুকনো দাগ। ফকির মোল্লা তার স্পন্দন পরীক্ষা করে ভারাক্রান্ত গলায় বলল, অনেক আগেই গেছে। আশরাফ কঁকিয়ে কেঁদে উঠে বলল, আম্মা তাহলে আব্বার কাছেই আসতো। আমরা কেউ বুঝিনি। কিন্তু আজ ফিরল না কেন বাড়িতে?

ফকির মোল্লা ওর পিঠে হাত রাখে। সস্নেহে বলে, বুঝি অনেকদিন ধরেই তোর আম্মা সুলতানকে বলছে ওর কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আজ মনে হয় শেষবারের মতো না বলে দিয়েছে। আর কেঁদে লাভ নেই। মার জন্য গর্ব করতে-করতে বাড়ি ফিরে গিয়ে একটু ধাতস্থ হয়ে আয় । সঙ্গে কাউকে পাঠাচ্ছি। আমরা সব ব্যবস্থা করছি এখানে।

বাড়ি ফিরতে-ফিরতে আশরাফ এমন কাঁদতে থাকলো ওর সদ্য গতায়ু মা, যেন আকাশ-মা রিমঝিম সুরে স্নেহধারা হয়ে ঝরতে শুরু করলো। ওদিকে তখন ফকির মোল্লা সবাইকে নিয়ে কাজে লেগে পড়েছে পারলৌকিক-ক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য। একজন বৃষ্টির কথা তুললে সে সরোষে বলে ওঠে, গ্রামের প্রথম সতী-নারীর জন্য একটু কষ্ট স্বীকার করে নিতে পারো না ? না পারলে বিদেয় হও।

সে একরাশ লজ্জায়  ভিজতে-ভিজতে কাজে নেমে পড়লো। সবার চেয়ে এগিয়ে গেলো । 

Comments

Popular posts from this blog

আলী হোসেনের ছোটগল্প। এক এক্কে এক।

এক এক্কে এক : ছোট্ট বেলা নামতা পড়ার সময় এভাবেই শুরু করত মান্তু। তখন জানতো না কি এর মানে, কেনই বা পড়তে হয়। মা বলতেন, নামতা হল অঙ্কের মাথা। কিম্বা মেরুদণ্ডও বলতে পারিস। এটা ঠিকঠাক না শিখলে অঙ্ক মেলে না। যখন প্রাথমিক স্কুল ছেড়ে মাধ্যমিকে পৌছেছে, তখন মায়ের কথার মানে বুঝেছে মান্তু। কিন্তু পরিণত বয়সে এসে, আজ বুঝেছে এর অন্য মানে। এটা না জানলে, জীবনের মানেটাই পালটে যায়। মিলতে চায় না জীবনের অঙ্কটাও। মান্তু তখন ক্লাস এইটে। হঠাৎই দুঃসংবাদটা এলো। ক্লাসে সেলাই দিদিমনি, ফ্রেঞ্চনটের গীট ধরে আটকানোর চেষ্টা করছেন। বোঝাচ্ছেন, কিভাবে একে কব্জা করতে হয়। মান্তু কিছুতেই এই গিঁটকে কব্জা করতে পারছেনা। মাথার ওপর বোঁবোঁ করে ঘুরছে পাখা, অথচ ঘামের স্রোতে ভাঁটার টান নেই মোটেও। বাইরের বাতাসে উত্তাপের পারদ নিশ্চয়ই লু-লেবেল ছাড়িয়েছে। বাতাসের শুষ্ক বুকে তরঙ্গ তুলে সে ছুটে চলেছে শরীর জুড়াতে আন্য কোথাও, অন্য কোনখানে। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে চাঁদনি থেকে দোকানের মাল নিয়ে ফিরছিল ফারহাদ। হঠাৎই চরকির মত ঘুরে গেল মাথাটা। পিচ-গলা রাস্তায় আছড়ে পড়লো মস্ত শরীর। পথ-চলতি নজর চকিতে ঘুরে এল ফারহাদের দিকে। কে বলে কলকাতার হৃদয়ে উষ্ণতার অভা

শুভ্রা সাহার ছোটগল্প। লকডাউন।

গল্পকারের কন্ঠে গল্প পাঠ। গল্পের নাম : লক ডাউনের গল্প গল্পকারের কন্ঠে গল্প পাঠ। গল্পের নাম : লক ডাউন গল্পকারের কন্ঠে গল্প পাঠ। গল্পের নাম : লক ডাউনের গল্প আলোচিতা এখন আর আগের মতো বোর হয় না। ঘরে বসেই ছোট বোন সঞ্চিতাকে নিয়ে অনলাইনে গান, বন্ধুদের সঙ্গে গল্প, বিভিন্ন প্রোগ্রাম করে সময় কাটিয়ে দেয়। লকডাউন-এ পড়ে কি যে নাজেহাল অবস্থা সকলের! মাত্র কয়েকদিন আগে, দিল্লি থেকে বাড়ি ফিরেছে সে। তখন তো ওর আসার কথাই ছিল না। হঠাৎ বাবার হার্ট অ্যাটাক হওয়াতেই আসতে হলো। আলোচিতা অর্থাৎ আলো। আর সঞ্চয়িতা অর্থাৎ সঞ্চিতা। ওরা দু'বোন। বাবা বিরাজবাবু স্কুলের শিক্ষক। মা রূপালি দেবী গৃহিণী। আলো দিল্লিতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেছে গতবছর। সঞ্চিতা দ্বাদশ শ্রেণীতে। শিক্ষকতা করার সুবাদে আলোর বাবা বিরাজ বাবুর এলাকায় যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। ওদের এলাকায় হিন্দু মুসলিমের সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি। বিরাজ বাবুর অনেক মুসলিম ছাত্রও আছে, যারা প্রায়ই ওনার কাছে আসে। বিভিন্ন মতামতের জন্য। বিরাজবাবু বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন। সুনাম

সুদীপ্ত ভাস্কর দত্তের ছোটগল্প। ২০২১ : করোনার পরে।

audio testing গল্পকারের কণ্ঠে গল্প পাঠ  ২০২১ : করোনার পরে নদীর জলটা এত টলটলে, পরিষ্কার আগে দেখিনি কোনদিন! পাড়ে বসে একটা মুগ্ধতা নিয়ে স্বগতোক্তি করল অরুণ। বসন্তের আরম্ভে এই মৃদুমন্দ বাতাসটা প্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছিল।। পড়ন্ত বিকেলে নির্জন নদীর তীরে, গাছের পাতার আড়াল থেকে একটা বউ কথা কও মাঝে মাঝে ডেকে উঠছিল। করোনা মহামারী রোধের চেষ্টায় সারা পৃথিবী জুড়ে যে লক ডাউন চলেছিল, তার ফলেই প্রকৃতি এখন দূষণমুক্ত, নির্মল।